গ্রাহকরা বঞ্চিত,বীমাখাতে অলস অর্থের পাহাড়

12
850

বর্তমানে শুধু লাইফ ফান্ডেই বিনিয়োগযোগ্য অর্থ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। নীতিমালার অভাবে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগে আনতে পারছে না বীমা কোম্পানিগুলো। ফলে এ বিশাল অলস ফান্ড জমে রয়েছে লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। এ অর্থ বিনিয়োগে এলে পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা

আরো মুনাফা পেতেন। ফলে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। এক্ষেত্রে নীতিমালা এবং উপযোগী খাতের অভাবকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নেতারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৫৮ সালের নীতিমালায় চলছে বীমা কোম্পানির বিনিয়োগ। ফলে সরকারের বড় কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয়ও বিনিয়োগ নীতিমালা রয়েছে। তারা সরকারের বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। আমাদের পক্ষেও বিনিয়োগ সম্ভব। কিন্তু নীতিমালার অভাবে করা যাচ্ছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা। বীমা বিশেষজ্ঞদের মতে, অলস পড়ে রয়েছে তা ঠিক নয়। টাকাগুলো ব্যাংকে জমা আছে। তবে বিনিয়োগে আনতে পারলে ভালো মুনাফা আসতো। জীবন বীমা খাতে গ্রাহক যে টাকা জমা করে তাকে লাইফ ফান্ড বলে। বিআইএ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালে লাইফ বীমাখাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর উপার্জিত প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৯৫ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে এ আয় ছিল ৭ হাজার ৯২৪ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে প্রিমিয়াম কমেছে ৮২৯ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা বা ১০.৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে নন-লাইফ বা সাধারণ বীমা খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ বেড়েছে ৪.৪৬ শতাংশ। হিসাব অনুসারে, ২০১৬ সালে কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ডের পরিমাণ ২৭ হাজার ৪৭১ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা ২০১৫ সালে ছিল ২৬ হাজার ৩৭২ কোটি ৫৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৬ সালে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর লাইফ ফান্ড বেড়েছে ১ হাজার ৯৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বা ৪.১৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে বেসরকারি লাইফ বীমাখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩১ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা, যা ২০১৫ সালে ছিল ২৩ হাজার ৩৮১ কোটি ৬৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৬ সালে লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বেড়েছে ৬৪৯ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা, যা ২.৭৮ শতাংশ। একইভাবে মোট সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে বেসরকারি লাইফ বীমাখাতে। ২০১৫ সালে লাইফ বীমাখাতে মোট সম্পদ ছিল ৩১ হাজার ১১২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। যা ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৭৬৭ কোটি ৫৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৬ সালে কোম্পানিগুলোর সম্পদ বেড়েছে ১ হাজার ৬৫৪ কোটি ৯৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা ৫.৩২ শতাংশ। এদিকে ২০১৫ সালে নন লাইফ কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৩০ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৩৯ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৬ সালে নন-লাইফ বীমাখাতে প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে ১০৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। শতকরা হিসেবে যা ৪.৪৬। ২০১৬ সালে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে এই সম্পদের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩০৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৬ সালে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৪৮১ কোটি ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা, যা ৭.৬৩ শতাংশ। একইভাবে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে বেসরকারি নন-লাইফ বীমাখাতে। ২০১৫ সালে কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২১৬ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। যা ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪০১ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাত ২০১৬ সালে নন-লাইফ বীমাখাতে বিনিয়োগ বেড়েছে ১৮৫ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বা ৫.৭৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে জীবন বীমা খাতের লাইফ ফান্ডে আয়ের স্থিতি বেড়েছে। হিসাব অনুসারে, এক বছরে তহবিল বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। আইন অনুসারে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি বছর সরকারি ট্রেজারি বন্ডে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হয়। এই ৩০ শতাংশসহ মোট ৫০ শতাংশ বা সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে এখনো বিনিয়োগযোগ্য তহবিল রয়েছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বীমা খাতের অর্থ বিনিয়োগের একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। তাহলে স্বচ্ছতা থাকবে। আর সার্বিকভাবে এ খাতের উন্নয়নে আস্থার সংকট কাটাতে হবে। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট এবং পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএম ইউসুফ আলী বলেন, এ টাকা বিনিয়োগের জন্য সরকারি একটি নীতিমালা দরকার। অলস অর্থ বিনিয়োগ করতে পারলে কোম্পানি ও সরকার উভয়ে লাভবান হবে। তিনি বলেন, ভারতে লাইফ ফান্ডের জন্য নীতিমালা রয়েছে। আর আমরা এখন প্রক্রিয়াধীন। জানা গেছে, বিশাল এই তহবিল গ্রাহকের পলিসির টাকা। এতে মুনাফা হলে গ্রাহকের বীমা দাবি পূরণ সহজ হয়। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার কম। ফলে ব্যাংকে এফডিআর করলে খুব বেশি লাভ আসে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহক ও শেয়ার মালিকেরা। জানা গেছে, গ্রাহকদের বীমা দাবি পূরণ না করাসহ বীমা খাতে বিশাল অনিয়ম রয়েছে। ফলে এ খাতের প্রতি সর্বজনীন একটি নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। সক্ষমতা বিবেচনায়ও দেশের অন্যান্য খাতের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে এ খাত। দক্ষ জনবল নেই। প্রয়োজনীয় এবং হালনাগাদ কোনো আইন নেই। সরকারের প্রয়োজনীয় নজরদারিও নেই। ফলে চরম স্বেচ্ছাচারিতা চলছে এ খাতে, যা উদ্যোক্তারাও স্বীকার করেন। বিআইএ সভাপতি শেখ কবীর হোসেন বলেন, লাইফ বীমার টাকা সব দেশে সরকারিভাবে বিনিয়োগ হয়। এতে গ্রাহকরা বিনিয়োগ থেকে আসা লাভের একটা অংশ গ্রাহক পায়। গ্রাহকরা উপকৃত হয়। এছাড়া গ্রাহকের টাকা অপব্যবহারের সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারিভাবে বিনিয়োগ হয় না। তবে বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেশ যোগ্য। তারা বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো কিছু একটা করতে পারবে বলে আশা করেন তিনি। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৭৫টি বীমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে জীবন বীমা ৩০টি এবং সাধারণ বীমা ৪৫টি। আর এই দুই খাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬টি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − eleven =