রাজধানীজুড়ে গ্যাসের সঙ্কট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বলছে না চুলা- কমছে না গৃহিণীদের দুর্ভোগ

0
833

রাজধানীজুড়ে গ্যাসের সঙ্কট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীত জেঁকে বসতে না বসতেই নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গ্যাস সঙ্কটে সমস্যা হচ্ছে নিত্যদিনের রান্নায়। অধিকাংশ এলাকায় সকাল থেকে বিকেল অবধি গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। ফলে বাধ্য হয়ে রাতে অথবা কাকডাকা ভোরে দিনের রান্নার

কাজ শেষ করতে হচ্ছে গৃহিণীদের। কোনো দুর্ঘটনা বা বিপত্তির জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র রয়েছে। ঢাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাসের সঙ্কট নতুন কিছু নয়। তবে আগে ছিল শুধু শীতকালে, এখন সারা বছর। গ্যাসের দাম চলতি বছর দেড় গুণ বাড়লেও গৃহিণীদের দুর্ভোগ কমেনি, বরং বেড়েছে। তিতাসের পাইপলাইন গ্যাস সুবিধা থাকা সত্তে¡ও রাজধানীর বহু এলাকায় এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন গৃহিণীরা। কারণ তিতাসের গ্যাস সারাদিনই থাকে না। অনেকেই বলছেন, তারা বড় বিপাকে আছেন। কারণ তিতাসের লাইনের গ্যাস না পেলেও প্রতি মাসে তাদের বিল গুনতে হচ্ছে ৯৫০ টাকা। এদিকে সিলিন্ডার গ্যাসের পেছনেও মাসে গুনতে হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা। আগামী এপ্রিল মাসে এলএনজি আমদানি শুরু হলে গ্যাসের ঘাটতি ৫০ শতাংশ দূর হবে। তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তখন আবাসিক এলাকায় গ্যাস সঙ্কট থাকবে না বলে জানিয়েছেন তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান। জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে শীত দেখা দিলে তখনও নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় গ্যাস সঙ্কট দেখা দেয়। কয়েক দিনে জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে যতগুলো অভিযোগ এসেছে তার শতকরা ৭০ ভাগই গ্যাসের অস্বাভাবিক সরবরাহ সংক্রান্ত। গত দুই বছর ধরে ঢাকার কয়েকটি এলাকায় সারা বছর ধরেই গ্যাসের সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে মোহাম্মদপুর, বসিলা, আদাবর, পশ্চিম আগারগাঁও, মিরপুরের শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, কাফরুল, পশ্চিম ধানমন্ডি, লালবাগ, সোবহানবাগ, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, যাত্রাবাড়ীর একাংশ, দক্ষিণ বনশ্রী, রামপুরার শিমুলবাগ, আশিষ লেন ও উলন রোড এলাকায় গ্যাসের ভয়াবহ সমস্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় সারাদিন চুলা জ্বলে না। জ্বললেও মিটমিট করে। কোথাও সকালেই গ্যাসের চাপ কমে যায়। আসে দুপুরে। কোথাও সন্ধ্যায় গ্যাস পাওয়া যায়। গ্যাসের চাপ পাওয়া যায় মূলত রাত ১১টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত। গত কয়েক দিন আগে উত্তরা ও গুলশানের জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে টেলিফোনে অভিযোগ করা হয়েছে যেগুলো ছিল গ্যাসের অপ্রতুল সরবরাহ সংক্রান্ত। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় সংসদ ভবনের কেন্টিনেও গ্যাস সরবরাহ নেই বলে অভিযোগ এসেছে। এছাড়া লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, লালবাগ, আজিমপুর, বাংলামোটর, খামারবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা, ইব্রাহিমপুর, ডিওএইচএস, বসুন্ধরা, মিরপুর আলীবাগ, আশকোনা প্রেমবাগান, যাত্রবাড়ী, পুরাতন ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের এই সঙ্কট চলছে। রাজধানী লালবাগের বাসিন্দা গৃহবধূ হাজেরা বেগম গত দুই-তিন দিন যাবৎ সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার রাতের বেলায় শেষ করে রাখছেন। তিনি বলেন, সকালবেলা গ্যাসের গতি এতটাই কম থাকে দুই-চার কাপ চায়ের জন্য পানি ফোটাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। তাই নিরুপায় হয়ে রাতের বেলা রান্নার কাজ শেষ করে রাখছি। রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী গৃহবধূ ফাতেমা বেগম প্রতিদিন সকালে স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়ে ও ব্যবসায়ী স্বামীর জন্য দুপুরের খাবার রান্না করে তারপর অফিসে রওনা হন। হটপটে করে নিজের জন্যও নিয়ে যান লাঞ্চ। কিন্তু গত দু’দিন যাবত লাইনে গ্যাস না থাকায় ঘরে রান্নাবান্না বন্ধ। এ সময় বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে বাধ্য হয়েছেন। বিকেলে অফিস থেকে ফিরেও একই অবস্থা। এক কাপ চা খাবেন সেই পানিও গরম করার চাপ নেই। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা তাসলিমা বেগম বলেন, তীব্র গ্যাস সঙ্কটে খুব সমস্যায় পড়েছেন। সকাল ৭টা বাজতে না বাজতেই গ্যাস চলে যায়। লাইনে টিপ টিপ করে গ্যাস আসায় রান্নাবান্না বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অনেক গৃহবধূ চুলায় হাঁড়ি চড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে গ্যাস আসার অপেক্ষা করছেন। গোসলের জন্য চুলায় পানি গরম করব তারও চাপ নেই। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিয়মিত গ্যাস বিল পরিশোধ করেও প্রয়োজনের সময় গ্যাস পাচ্ছি না। জ্বালানি বিভাগের এক যুগ্ম সচিব জানান, রাজধানীতে গ্যাস সমস্যার একটি বড় কারণ চুরি। আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় অবৈধভাবে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। তার মতে, প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। মাঝে মাঝে তিতাস অভিযান চালিয়ে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও স্থানীয় প্রভাবশালীরা তিতাসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় আবার চালু করে। এতে বৈধ গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ঢাকা ও এর আশপাশে চার থেকে পাঁচ লাখ অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। তিতাস গ্যাস কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক দিন যাবৎ রাজধানীতে তীব্র আকারে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। এ কারণে আবাসিকে চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া তীব্র শীতের কারণে বিভিন্ন লাইনে গ্যাস জমে যাওয়ায়ও স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী এইচ এম আলী আশরাফ বলেন, রাজধানীতে গ্যাসের চাহিদা ও ব্যবহার শতকরা ২০ ভাগ বেড়েছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী গরমকালেই অনেক সময় গ্যাসের সরবরাহ ব্যাহত হয়, আর এখন শীতের কারণে চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গ্যাস কোম্পানি ও জ্বালানি বিভাগ, সিএনজি স্টেশন মালিক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চারটি কারণে বর্তমানে গ্যাসের সঙ্কট প্রকট। এগুলো হলোÑ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি, বিতরণ পাইপলাইনে সীমাবদ্ধতা, বসতি বেড়ে যাওয়া ও অবৈধ সংযোগ। গত বছর দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস পাচ্ছেন না কেন জানতে চাইলে দাম বৃদ্ধির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের এক সদস্য বলেন, মূলত উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান থাকায় অনেক গ্রাহক বঞ্চিত হচ্ছেন। এলএনজি আমদানি শুরু হলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাস চুরি বন্ধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, কলকারখানায় জ্বালানি অদক্ষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দক্ষতার বয়লার ব্যবহৃত হয়। যেখানে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড হলো ৮৫ শতাংশ। আবাসিকের সব গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে হবে। তাহলে গ্যাসের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম ইনকিলাবকে বলেন, এলএনজি আমদানি শুরু হলে গ্যাসের ঘাটতি ৫০ শতাংশ দূর হবে। তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এলএনজি এলে তা শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতের ঘাটতি মেটাতে ব্যবহার হবে। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতিই সমস্যার মূল কারণ। তিনি জানান, তিতাসের এলাকায় গ্যাসের চাহিদা ২২০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হচ্ছে ১৭০ কোটি ঘনফুট। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেয়া সম্ভব নয়। কিছু কিছু এলাকায় বিতরণ লাইনগুলো অনেক সরু। ফলে লাইনের শেষ প্রান্তে যারা বাস করেন, তাদের গ্যাস পেতে সমস্যা হয়। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তারা ৫০০ কিলোমিটারের বেশি অবৈধ বিতরণ লাইনের অপসারণ করেছেন। দেড় লাখের বেশি অবৈধ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন। এরপরও কিছু এলাকায় আবার অবৈধ সংযোগ চালু হচ্ছে। এর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত। প্রতি জেলায় অবৈধ সংযোগ বন্ধে ডিসিদের নেতৃত্বে কমিটি আছে। তারা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। এদিকে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে আবারও শুরু হয়েছে গ্যাসের সঙ্কট। দিনের বেলা বাসা-বাড়িতে গ্যাস না থাকায় গভীর রাতে রান্নাবান্না করতে হচ্ছে গৃহিণীদের। আবার কোথাও কোথাও রাতে গ্যাস থাকছে না। এতে করে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। গ্যাস না থাকায় অনেকে মাটির চুলা বানিয়ে রান্নার কাজ সারছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

6 + 8 =