বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ কর্মকর্তা সন্দেহের তালিকায়

0
628

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় পাঁচ দেশের ৪৩ ব্যক্তি ও ৫ প্রতিষ্ঠান জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। সন্দেহের তালিকায় আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ শাখায় কর্মরত অন্তত ১৪ জন কর্মকর্তা ও একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি। বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্ট এই সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ওই সংবাদে বলা হয়, ভারতীয় একটি কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের সঙ্গে আরটিজিএস সংযোগ দেয়ার পরই রিজার্ভ চুরির সুযোগ তৈরি হয়।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে সুইফট মেসেজিং সিস্টেমের মাধ্যমে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে রাখা বাংলাদেশের ১০০ কোটি ডলার ডলার সরিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মেসেজে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার যায় ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকে (আরসিবিসি)। আর আরেক আদেশে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো হয় ২০ লাখ ডলার।

শ্রীলঙ্কায় পাঠানো অর্থ ওই অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া আটকানো গেলেও রিজল ব্যাংকে যাওয়া অর্থের বেশিরভাগটাই বের হয়ে চলে যায় স্থানীয় একটি কেসিনোতে জুয়ার টেবিলে। এই ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এক ক্যাসিনো মালিক ফেরত দিয়েছে দেড় কোটি ডলার। এই টাকা ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ঘটনায় রিজল ব্যাংককে জরিমানা করা ২০ কোটি ডলারও পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি টাকার মধ্যে ফিলরেম মানি রেমিটেন্স কোম্পানির কাছে আছে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ওই বাজেয়াপ্ত করতে দেশটির আদালতে মামলা চলছে। সোলায়ার নামের একটি ক্যাসিনোতে গিয়েছিল ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ওই অর্থ ফিলিপিন্সের আদালত ফ্রিজ করে রেখেছে। এ বিষয়ে আরেকটি মামলা বিচারাধীন। তবে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই পুরো অর্থই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। ২০১৬ সালে চার ফেব্রুয়ারি ঘটা এই চুরির ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারে এক মাস পর। ওই সময়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ঢাকায় মামলা করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি দুই বছরেও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি।

তবে সিআইডি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ইনডিপেনডেন্ট টিভি বলছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ শাখার অন্তত ১৪ জন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার সন্দেহ করছে তারা। বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও আছেন সন্দেহের তালিকায়। তিনি চুরির সময় সুইফট এসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ছিলেন।

সন্দেহের তালিকায় আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব ও বাজেট শাখার একজন যুগ্ম পরিচালক, দুই জন উপ-পরিচালক, এক জন উপ-মহাব্যবস্থাপক, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের এক জন উপ-মহাব্যবস্থাপক, দুই জন যুগ্ম পরিচালক ও দুই জন উপ-পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা।

এর বাইরে আইটি শাখার এক জন উপমহাব্যবস্থাপক, এফএসএসএস পিডি বিভাগের একজন উপমহাব্যবস্থাপক ও ফরেক্স শাখার একজন উপ-পরিচালক আছেন সন্দেহের তালিকায়। ফরেক্স শাখার সন্দেহভাজন ওই কর্মকর্তার কক্ষেই হ্যাকাররা প্রথম আক্রমণ চালায়।

সিআইডি বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের সাথে আরটিজিএস সংযোগ দেয়ার কাজ দিতে ভারতীয় নাগরিক এডি হাদ্দাদকে সহায়তা করেছিলেন নির্বাহী পরিচালক পদমর্যার এক কর্মকর্তা। আরটিজিএস কানেকশন দেয়ার পরই সুইফটের নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়ে।

আবার হ্যাক হওয়ার কথা জেনেও এডি হাদ্দাদ ও বাংলাদেশ সুইফট এসোসিয়েশনের তৎকালীন এক নেতা সে সময়ের গভর্নর আতিউর রহমানকে সুইফট খোলা রাখতে চাপ দিয়েছেন। তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই তিনজন রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন।

সিআইডি কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জানি কোন প্রক্রিয়ায় কে কে ছিল। কিছু তথ্য পেয়েছি, তবে সুনির্দিষ্ট তথ্য যখন আমরা পেয়ে যাব তখন আমরা অ্যারেস্টে যাব।’

মামলাটির তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিতে আরো সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ফিলিপাইনের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রিজার্ভ চুরিতে জড়িত। এগুলো হলো: রিজল (আরসিবিসি) ব্যাংক, ফিল্ডরেম মানি এক্সচেঞ্জ, বিকন কারেন্সী, ক্যাসিনো সোলেয়ার ও ইস্টার্ণ হাওয়াই।

সন্দেহের শীর্ষে সুইফটের প্রেসিডেন্ট এডি হাদ্দাদ, কর্মকর্তা নীলা ভান্নান, আর্থেস সুদিন্দ্র, প্রিতম রেড্ডি, অভিজিত কুমার সাহা, রবি সুভ্রানিয়াম ও সৌরভ কুমার।

চীনের নাগরিক গাওসুয়া, ডিংজে, শ্রীলঙ্কার শালিকা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শালিকা প্যারেরাসহ পাঁচ পরিচালক, জাপানের গাড়ি ব্যবসায়ী সাসাকি ও তার পর্বপরিচিত জয়দেবা রিজার্ভ চুরিতে সরাসরি জড়িত সন্দেহ সিআইডির। জয়দেবাই জায়কার ফান্ড নেয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে যায়।

ভুয়া নাম ঠিকানায় একাউন্ট খুলতে সহায়তা করে আরসিবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান লরেন্স তান, তৎকালীন ম্যানেজার মায়া দিগুতিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।

এই রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আলাদা একটি তদন্ত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে। ২০১৬ সালের ৩০ মে এই প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে তুলে দেয়া হয়। প্রতিবেদনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকাশের কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি এখনও।

এদিকে চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে যতটুকু ফেরত এসেছে, তার বাকিটা আদায়ে রিজল ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই মামলায় ?যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভকেও সঙ্গে নিচ্ছে তারা।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এই মামলা হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twenty + eleven =