বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরার মৃৎশিল্প

0
1243

বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনবদ্য রূপ লাভ করেছে মৃৎশিল্প। বিশ্বজুড়ে প্রত্যেক দেশে রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। এই শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হয় সে দেশ বা জাতি। এক একটি শিল্পের বিস্তারের পেছনে রয়েছে একটি দেশ বা জাতির অবদান। বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্র্যের দেশ। এদেশে অতীতকাল থেকেই হাজার ধরনের সংস্কৃতি পালন করা হয়। যার একটি নিদর্শন হলো ‘মৃৎশিল্প’। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যের রূপকার হলেন কুমার শ্রেণীর পেশাজীবীরা। এদেশের কুমার শ্রেণী হিন্দু সমপ্রদায়ভুক্ত, পাল পদবিতে পরিচিত।

বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজ করে আসছেন। ‘মৃৎ’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে সুন্দর সৃষ্টিশীল বন্তু। তাই মাটি দিয়ে নিজ হাতে তৈরি শিল্পকর্মকে ‘মৃৎশিল্প’ বলে। কুমাররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প। মাটি দিয়ে তৈরি এই শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে হাঁড়ি-পাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, খানদা, ফুলের টব, ফুলদানি, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, ঘটি-বাটি, ডাবর-মটকি, প্রতিমা, মাটির ব্যাংক, শো-পিস, পিঠা তৈরির ছাঁচ, নানা রকম খেলনা। এই শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো মাটি। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেকাংশে বেশি। পরিবেশবান্ধব এই শিল্প শোভা পেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে। সাতক্ষীরায় মৃৎশিল্প হারিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে- চাহিদা কম, জ¦ালানি সংকট, আয়ের সাথে ব্যায়ের অসংগতি, ঋন প্রাপ্তিতে জটিলতাসহ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য মৃৎশিল্প। পাশাপাশি আধুনিকতার ছোয়ায় প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ নানা ধরনের সাংসারিক জিনিসপত্র তৈরিতে বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। কুমারের সাথে কথা জানা যায়, আধুনিকতার ছোয়ায় অনেক কুমোররা পেশা পরিবর্তন করে ঝুকে পড়েছে অন্য পেশায় বা পাড়ি জমিয়েছে অন্য দেশে। তারপরও জরাজীর্ণ কিছু কুমোর পরিবার ধরে রেখেছে বাপ-দাদার এই পেশাকে। সাতক্ষীরারতালা,কলারোয়া,কালিগঞ্জ,দেবহাটা,আশাশুনি,শ্যামনগর উপজেলার এলাকায় এখনো চোখে পড়ে পানিতে মেশানো নরম কাঁদা চাকার উপরে ঘুরিয়ে তৈরি করছে সংসারে ব্যবহৃত হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন ধরণের জিনিসপত্র। লাভহীন এই পেশাকে বর্তমানে বাপ-দাদার পেশা রক্ষায় আকড়ে রেখেছে মুষ্টিমেয় কিছু কুমোর পরিবার। যাদের অনেকেই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ভবিষ্যতে যেন এই শিল্প আর ধ্বংসের পথে ধাবিত না হয় সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মা আর মাটির সাথে এদেশের মানুষের নাড়ির টান। আবহমানকাল থেকেই বাংলা ও বাঙালি নামের সাথে মিশে আছে মাটির গন্ধ। কুমার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় অনন্য হয়ে উঠুক আমাদের মাটির দেশের এই মাটির শিল্প।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 × three =