জনবহুল বিসিক অঞ্চলে চসিকের উন্মুক্ত ময়লার ডিপো! চারদিকে ভঙ্গুর রাস্তা, দূষণ আর দূষণ, নিরব পরিবেশ-প্রশাসন

0
1132

ইমরান ঃ
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) শিল্প নগরীর বি.এফ.আই.ডি.সি সড়কের জনবহুল শাপলা ক্লাব মোড়ের ১১ একর জায়গা জুড়ে চসিক প্রতিদিন হাজার হাজার টন পচাঁগলা ময়লা আবর্জনার পাহাড় গড়ে তুলে এ অঞ্চলে কর্ম ও বসবাসরত  ৩ লক্ষাধিক মানুষকে দূষনের কবলে ঠেলে দিয়েছে। এই সড়কটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪ নং চাঁদগাঁও ও ৫ নং মোহরা ওয়ার্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শিল্প সড়ক। প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক ও বাসিন্দা এ রাস্তায় যাতায়াত করে। পচাঁগলা ময়লায় সারা বছর স্যাতস্যাতে থাকায় বিসিকের রাস্তা ও নালা গুলো ভেঙ্গে খাল হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে তা সাগরে পরিনত হয়। দেখার যেন কেউ নেই। বিসিক ও চসিকের ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষায় ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোগতা ও এলাকাবাসী। এ প্রতিবেদক সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে দেখা যায় ময়লার ডিপোর চারদিকে দূষণ কবলিত হয়ে ইতিমধ্যে মরে গেছে ছোট-বড় অনেকগুলো ফলদ-বনজ গাছপালা। এলাকাবাসী থেকে খোজ নিয়ে জানা যায়, আর্বজনার চাপে পড়ে নষ্ট হয়েছে নারকেল ও সুপারী বাগান। ডিপোর ভিতরে বাহিরে ব্যাক্তি মালিকানাধীন ৪টি পুকুরে বিষাক্ত কালো পানিঢুকে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জনকল্যাণে গড়া ৩টি জলাশয় ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। যে গুলো এলাকার সর্বস্থরের জনগন প্রায় শত বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে। স্থানীয় পাম হাউজের এপিও মুসলেহ উদ্দীন কে প্রশ্ন করলে জানায়, চট্টগ্রাম ওয়াসার একমাত্র পাম হাউজটি ময়লা পানি ও দূর্গন্ধে ভরে গেছে। বউ বাচ্ছা নিয়ে চলে গেছে এখানকার কেয়ার টেকার। ময়লার স্তূপের নিছে ওয়াসার সঞ্চালন লাইন ফেটে গেলে পানিতে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। অতিকষ্টে সারানো গেলেও মানুষের সন্ধেহ রয়ে গেছে”। সুপেয় পানির অভাবে বহুদুর থেকে পানি এনে ব্যবহার করছে সাধারণ মানুষ। মরে গেছে পুকুরগুলোর হাজার হাজার মাছ। নষ্ট হয়েছে এলাকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। বর্জ থেকে নির্গত বিষাক্ত তরল থেকে উৎপন্ন আর্সেনিক সীসা ও জীবন হরণকারী রাসায়নিক দ্রব্যের সম্পৃক্ততায় চর্মরোগ, পেটের পীড়া ও ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া জনিত নানা দূরারোগ্য ব্যাদী সহ স্থানীয় বাসিন্দাদের মৃত্যুর ঝুকি বেড়েছে। এবং প্রতিটি নলকুপ আর্সেনিক কবলিত হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় জনসাধারণ। এই এলাকাটি পঞ্চাশ বছর ধরে অভিজাত প্রসাধনী শিল্প (লিভার ব্রাদার্স), সরকারী বন শিল্প সংস্থা, কৃষি মন্ত্রনালয়ের বৃহৎ কৃষিভবন, বার্জার পেইন্টসহ শত শত রপ্তানীমূখী পোশাক শিল্প এবং বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা এই অঞ্চলে খাদ্য, ঔষুধ, প্রসাধনীসহ শত শত ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। ভারী শিল্প হিসেবে সিমেন্ট, লৌহজাত, অটোমোবাইল শিল্প এর আগে বহুদিন ধরে একটি নিরাপদ পরিবেশে তাদের প্রতিষ্ঠান চালু রেখেছে। উল্লেখিত শিল্প প্রতিষ্ঠানে রাতদিন বিরতিহীনভাবে প্রায় ২লক্ষ শ্রমিক এই বি.এফ.আই.ডি.সি সড়ক এলাকায় নিরাপদে বসবাস ও কাজ করে আসছে। তাছাড়াও এ পথ ধরে চলাচল করছে স্থানীয় নাথ পাড়া, বড়–য়া পাড়া উত্তর দক্ষিণ, ছালেহ আহমদ চৌধুরী পাড়া, কদল মাঝি পাড়া, রিদওয়ান চৌধুরী বাড়ী, বিএডিসি কলোনী, আফজাল মাঝি পাড়া, খারিসান মাঝি পাড়া, জালাল ড্রাইভার বাড়ী, ও নুরুল হক কন্ট্রাকটরের বাড়ীর লক্ষাধিক মানুষ। এই সড়কের সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে আসা যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ থাকায় এলাকাটি জনবহুল এবং দিনরাত মানুষের পদচারনায় মুখর থাকে। বিভিন্ন বিপনী বিতান কেন্দ্র, কাচাঁবাজার এবং খাবারের দোকানে জনমানুষের অবিরত সমাগম লেগে থাকে। বাংলাদেশ পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় চেয়ারম্যান এডভোকেট মোস্তফা নুর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বসবাসরত হাজার হাজার মানুষের প্রয়োজনে এখানে প্রায় ৭টির মত স্কুল, মাদ্রাসা, প্রায় ৮টি মসজিদ রয়েছে, যাহার মধ্যে ১টি মাদ্রাসা আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত। শ্রমিক, কর্মচারী, সাধারণ মানুষ ও দেশী বিদেশী উদ্যোক্তাদের এই সড়কটিই একমাত্র সহজ ও সচল সড়ক হিসাবে বিবেচিত। এই ধরনের জনবহুল গুরত্বপূর্ন শিল্পাঞ্চলে প্রতিদিন হাজার হাজার টন ময়লা আবর্জনা ফেলে কোন দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের পরিবেশ, শিল্প বিকাশ, জনস্বাস্থ্যের প্রতি চরম অবহেলা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি সচেতন জাতি, রাষ্ট্র ও সরকার যেখানে পরিবেশ ও শিল্প বিকাশ এবং জনস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করছে। এ অবস্থায় কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা সংস্থা পরিবেশ দূষনের দায়িত্ব নেয়াটা যুক্তিসংগত বলে মনে করেনা সচেতন মহল। শিল্প নগরীর কয়েকটি পরিচিত কারখানার কিছু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, বিগত ৫০ বছর পূর্বে অর্থাৎ পাকিস্থান আমলে চট্টগ্রাম পৌরসভা আধুনিক কসাইখানা করার জন্য বর্তমান ময়লার ডিপোর ১০ একর ভূমি অধিগ্রহন করে। কিন্তু যখনি এই এলাকা শিল্প উদ্যোক্তাদের কাছে শিল্প বিকাশের জন্য উপযোগী হিসাবে বিবেচিত হয়, তৎকালীন পৌরসভা পরিবেশ দূষনমুক্ত রাখতে উক্ত কসায়খানা করার সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে। যেখানে ক্ষুদ্র পরিসরে একটি পৌরসভা পরিবেশ সুরক্ষার জন্য তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করে, সেখানে বর্তমান সিটি কর্পোরেশনের কি হল যে? ময়লা ডাম্পিং করার র্নিধারিত জায়গা থাকা স্বত্বেও হটাৎ করে পূর্বঘোষনা ছাড়ায় কি কারনে এই শিল্প ও জনঅধ্যুষিত এলাকাকে হাজার হাজার টন ময়লা ফেলে শিল্প বিকাশের পথ বন্ধ করে জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি প্রদানের দায়িত্ব গ্রহন করল। শুধু আমরা নই যে কোন সচেতন জনগোষ্টির বুঝতে অপারগ। এই ব্যাপারে জন অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে। এ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ এক নেতার প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাই এলাকার প্রতি এ বৈষম্য বলে জনমনে চাপা গুঞ্জন আছে বলেও তারা জানান। স্থানীয় শাপলা ক্লাবের সভাপতি নাজিম উদ্দীনকে এ ব্যপারে গণ উদ্যোগ কি ছিল জানতে চাওয়া হলে তিনি এ ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে অপারগতা স্বীকার করে বলেন, “অনেক কিছু করেছি, দরখাস্ত নিয়ে মেয়র, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিসিক, প্রশাসনসহ নেতাদের কাছে ধর্না দিয়েছি। এলাকাবাসীকে নিয়ে স্থানীয় এমপি ও সিডিএ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মানব বন্ধন ও জনসভা করেছি। কোন কাজ হয়নি। বরং হেনস্থা হয়েছি, আমাকে পুলিশের কাছে এ বিষয়ে আর মাথা না গলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুছলেখা দিতে হয়েছে। তাই আমি দু:খিত এ বিষয়ে আর কথা বলতে চাইনা। সবার ভাগ্যে যা আমারও তা” একই বিষয়ে এলাকার সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, এখানে জনসাধারণের ব্যবর্হায কয়েকটি পুকুরসহ খুব সুন্দর,সবুজ, চির হরিত একটি নারকেল ও সুপারী বাগান ছিল। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে এ সুন্দর বাগানে হটাৎ ময়লা ফেলানো শুরু করলে এলাকাবাসী প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আমি ও মহিলা কাউন্সিলর চসিক মেয়রকে অবহিত করে এলাকাবাসীকে ময়লা অপসারনের জন্য আশ্বস্থ করি। তারাও মেয়র, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিসিক, প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানোর পরেও ময়লা অপসারনের বদলে চসিক প্রতিদিন আরো হাজার হাজার টন পচাঁগলা ময়লা আবর্জনার পাহাড় গড়ে তুললে অসহনীয় পরিবেশ তৈরী হয়। ফলে সিডিএর চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামের নেতৃত্বে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মঈন উদ্দীন খান বাদলের নেতৃত্বে মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি এ বিষয়ে ৮ম সংসদের পয়েন্ট অর্ডারে দাড়িয়ে পরিবেশ মন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করেও সুরাহা চান। কিন্তু এ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে ২/১ দিন ভাগাড়ে ময়লা ফেলা বিরতী দিয়ে বাসিন্দাদের আশ্বস্থ করলেও পরক্ষণে আবার দেখি ময়লা পর্বতের চুড়া উচু থেকে আরো উচু হতে থাকে। সম্প্রতি ময়লার গাড়ী আসা আবার কয়েকদিন বন্ধ আছে বটে তবে তা  অপসারনের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।’’ বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, এ আবর্জনা সরানো জন্য আমরা চসিক কে একাধিক বার অফিসিয়াল চিঠিপত্র প্রদান করেছি। তবে শিল্প নগরীর রাস্তা ও ড্রেনেজ সিস্টেম গুলো ভেঙ্গে যাবার জন্য শুধুমাত্র ঐ ভাগাড়ের ময়লা পানিই একমাত্র দায়ী, একথা পুরোপুরি সঠিক নয়। আরো অন্যান্য কারনও রয়েছে। এ গুলো মেরামত করার জন্য আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়ে বার বার জানিয়েছি, প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সামনের নতুন টেন্ডারে আমাদের প্রকল্পগুলো স্থান পাবে বলে আশা করছি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের প্রধান সফিকুল মান্নান সিদ্দিকীকে এ প্রতিবেদক কবে নাগাদ আর্বজনা গুলো অপসারন করা হবে জানতে চাইলে তিনি “অপসারন করা হবে’’ বলে সাদামাটা জবাব দিয়ে ফোন কেটে দেন। ময়লা অপসারনের ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অবস্থান জানার জন্য স্থানীয় কাউন্সিলর সাইফুদ্দীন খালেদকে ৩দিন যাবত বহুবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। ২য় দিন বিকালে একবার ফোন রিসিভ করলেও প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ডিসির মিটিং এ আছেন পরে কল ব্যাক করবেন বলে লাইন কেটে দেন। এরপর প্রতিবেদক পুনরায় অনেকবার ফোন করেও যোগাযোগ করতে ব্যার্থ হয়। তাই চসিকের এ ব্যাপারে অন্যকোন সৎ উদ্দেশ্য বা মহৎ পরিকল্পনা থেকে থাকলে আমরা তা প্রচার করতে না পারায় দু:খ প্রকাশ করছি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − 1 =