দুর্নীতি ও জালিয়াতে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আকন্দ অপ্রতিরোধ্য

0
1375

সিলেটের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম করে চলেছেন প্রধান শিক্ষক মোঃ বাহার উদ্দিন আকন্দ। তিনি এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ থাকা সত্বেও স্কুলের কাজ চালিয়ে বহাল তবিয়তে স্বপদে থেকে দাপট খাটাচ্ছেন। প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোন প্রকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না। শিক্ষক আকন্দের বিরুদ্ধে স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম, রেজুলেশন জালিয়াতের ঘটনা সহ তার আর্থিক দুর্নীতি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিকে’র) সাবেক সচিব সাবেরা আক্তার। তিনি শিক্ষক আকন্দের বিভিন্ন অনিয়ম জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করলে বা.উ. আকন্দকে অভিযুক্ত করা হয়। এই তদন্তে প্রমাণিত ও অভিযুক্ত আকন্দের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গালে অবস্থিত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা. উ. আকন্দের বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা প্রশাসনিক তদন্তে ধরা পড়ে। সিসিক পরিচালিত এই স্কুলটির সুনামের বদলে এখন দুর্নাম ছড়াচ্ছে। স্কুলের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কর্মচারী ও অভিভাবক মহল আকন্দের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা গেছে। তারা সকলেই আকন্দের অপরাধের দরুন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেছেন। বিগত ১১ জানুয়ারী তারিখে সিসিকের সাবেক সচিব সাবেরা আক্তার স্বাক্ষরিত একটি পত্রে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা উ আকন্দ একই তারিখে দু’টি কার্যবিবরণী সভার মধ্যে একটিতে তৎকালীন সভাপতি সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বিনা অনুপস্থিতিতে স্বাক্ষর দেয়া হয়। ওই তারিখে কামরা বিদেশে ছিলেন। একই তারিখে আরেকটি কার্যবিবরণী সভায় দাতা সদস্য এড. আব্দুল মালেকের স্বাক্ষর দেখানো হয়। অত্র বিদ্যালয়ের দুটি কার্যবিবরনী প্রস্তুত করা সম্পর্কে কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্য দিতে পারেননি দুর্নীতিবাজ শিক্ষক বা উ আকন্দ। একই সালের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসের বিনা বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেছিলেন বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখার সহকারী শিক্ষিকা রেহেনা বেগম। একই সালের ১৭ আগস্ট তারিখে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভায় ওই শিক্ষিকার ছুটি মঞ্জুর করা হয়। পরবর্তীতে ওই শিক্ষিকার শূন্য পদে রাখি বেগম নামে একজন সহকারী শিক্ষিকা নিয়োগ করা হলেও ছুটিতে থাকা শিক্ষিকা বেহানা বেগমের নামে বেতন উত্তোলন করে তিনির নামে স্বাক্ষর দেখানো হয় বেতন বইয়ে। অথচ রেহানা বেগম ওই সভায় বলেন, বেতন বইয়ে তিনি স্বাক্ষর কিংবা বেতন উত্তোলন করেননি। এসব জালিয়াত ও অনিয়মের কারণে সভায় বা উ আকন্দকে জেরা করলেও তিনি জবাব দিতে ব্যর্থ হন। ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে আকন্দ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় একটি ও জুলাই মাসে মাধ্যমিক শাখার দায়িত্ব পালনে নিয়ম ভঙ্গ করে দুটি ইনক্রিপমেন্ট গ্রহণ করেন। যা তদন্তে সত্যতা পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করে অতিরিক্ত ফি হিসেবে ১১ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জন প্রতি ২৬১০ টাকা হারে নিয়ে পরিবর্তে শিক্ষার্থীদেরকে ১২৪০ টাকার রসিদ প্রদান করেন। ছাত্ররা এর কারণ জানতে চাইলে বা উ আকন্দ তাদেরকে এডমিট কার্ড দেয়া হবে না বলে ভয় দেখান বলে সিলেট জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারী ও অভিভাবকবৃন্দ বা উ আকন্দের বিরুদ্ধে ডিসি বরাবর আরো একটি অভিযোগ দেয়া হয়। অভিযোগে তার বিরুদ্ধে রেজুলেশন জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাত ও অনিয়মের তদন্তের দাবী করা হয়। সে সব বিষয়ে ডিসির কার্যালয় আকন্দের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া চলতি বছরের ২রা জুন আকন্দকে সিসিকের সচিব, ১৭ জুলাই তাকে বিদ্যালয়ে হাজির থাকা ও আকন্দের অপরাধের তদন্তের জন্য নোটিশ দেয়া হয়। তিনি দেড় ঘন্টা বিলম্বে সকাল সাড়ে ১১টায় সিসিক সচিবের সামনে হাজির হয়ে বলেন, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা মতে তদন্তমূলক সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তিনি তদন্তকারীদের নিকট উপস্থাপন করবেন না বলে জানিয়ে এই অজুহাতে আকন্দ নিজেকে রক্ষা করে চলছেন। অন্যদিকে শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনার অজুহাত দেখিয়ে তার অপরাধের তদন্ত আড়ালের চেষ্টা করে শিক্ষক আকন্দ এখন অধরা। তাছাড়া সিসিকের সাধারণ সভায় বিবিধ আলোচনায় সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা উ আকন্দের বিভিন্ন অনিয়ম, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির কার্যবিবরণী জালের ও অবৈধ সুবিধা ভোগের, বেআইনী কাজের তদন্ত সহ আকন্দের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ সভায় সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গৃহিত হয়। ২০১৫ সালে সিসিকের তদন্তে বিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম ও দুটি কার্যবিবরণী রেজিস্ট্রারী বইয়ের ৬৩নং পাতায় একই সভায় দুইজনের সভাপতিত্ব জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। তাছাড়া শিক্ষক আকন্দের ইঙ্গিতে এবং নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে স্বঘোষিত একটি হিসাব নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরী করা হয়। বিগত জানুয়ারী-জুন ২০১৫ইং পর্যন্ত একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাত থেকে আয় হয়েছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার ৬শত ৮৫ টাকা। এই আয়কৃত টাকার মধ্যে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯শত ৫৮ টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। বাকী অবশিষ্ট ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭শত ২৭ টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে বা উ আকন্দ তালবাহানা শুরু করেন। ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনটিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীল স্বাক্ষরও নেই। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, অত্র বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থেকে কোন অর্থ কমিটি নেই। প্রতি মাসে সেখানে আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা করা হয়না। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা ৪০-১.২ অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটি আভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি গঠনের মাধ্যমে হিসাব নিরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু সে নিয়মগুলো পালন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠে। অন্যদিকে গত ১৭ জুলাই প্রধান শিক্ষক বা উ আকন্দ সিসিকের সচিব বরাবর লিখিত আবেদনে জানান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড সিলেটের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত নিরীক্ষা সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র তদন্ত কমিটিকে উপস্থাপন তিনি করবেন না। এরই ফাঁকে আকন্দ নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। আকন্দের অনিয়মের সংশ্লিষ্ট কাগজাদি ইতোমধ্যে প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। বা উ আকন্দের সাথে এ প্রতিবেদক সেল ফোনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সঠিক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি মহল তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। কিসের চক্রান্ত প্রশ্ন করলে তিনি সদুত্তর না দিয়ে বলেন আপনি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি সম্পূর্ণ অভিযোগ অস্বীকার করেন। রেজুলেশন জালিয়াতি ও আর্থিক অনিয়ম, ছাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি গ্রহণ সহ তার বিরুদ্ধে সিসিক কর্তৃক দু’দফা তদন্তে ঘটনা প্রমাণ পাওয়ার কথা বললে তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে সেল ফোন রেখে দেন। সিসিকে’র ১৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শনতু বলেন, শিক্ষক বা উ আকন্দ একজন বাজে লোক।  এতো দুর্নীতি করেও এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে তার থাকা উচিত নয়। কারণ তিনি বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাত, রেজুলেশন জালিয়াতি করে তদন্ত কমিটির কাছে ধরা খান। বা উ আকন্দ এই বিদ্যালয়ে যোগদানের আগে ওসমানী নগর থানার একটি স্কুলে শিক্ষকতা কালে বিভিন্ন অনিয়ম করায় ধরা খেয়ে তিনি সেখান থেকে বহিষ্কৃত হন বলে তিনি জানতে পারেন। সিসিকে’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এনামুল হাবীবের কাছে ফোনালাপে এ প্রতিবেদক শিক্ষক বা উ আকন্দের বিভিন্ন অপকর্মের কথা তুলে ধরলে তিনি বলেন, আগামীতে আরেকটি তদন্ত হবে। সেই তদন্তে আকন্দের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাডাও সিসিকের সাবেক সচিব সাবেরা আক্তারের তদন্তে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা উ আকন্দ এর বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতি প্রমাণিত হলেও কি কারণে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হলো না সে বিষয়ে এনামুল হাবীব বলেন, খুব শীঘ্রই আবার তদন্ত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five × 3 =