শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে ঠিকাদার-কর্মকর্তা সিন্ডিকেট লুটের মহোচ্ছপে একাট্টা

0
998

অপরাধ বিচিত্রাঃ
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রোজোনে নির্মাণ এবং সংস্কার কাজে ব্যাপক হরিলুট অব্যাহত রয়েছে। ঠিকাদার-কর্মকর্তা সিন্ডিকেট নামে-বেনামে হাতিয়ে নিচ্ছে উন্নয়ন কাজের সিংহভাগ টাকা। লুটের কৌশল হিসেব চক্রটি মন্ত্রী,এম.পি,সচিব এবং প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনার দোহাই দিয়ে গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেয়া হচ্ছে। বঞ্চিত ঠিকাদাররা এ ব্যাপারে মুখ খুললেই কালো তালিকাভুক্তির হুমকি দেয়া হচ্ছে। বঞ্চিত ঠিকাদাররা বলেছেন, নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা নজরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রোজোনে যোগদানের পর থেকে গোপন সমঝোতায় (ঘুপচি) পছন্দের ঠিকাদারদের মধ্যে কাজ বন্টনের রেকর্ড গড়েছেন। গত জুন মাস থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা জোনে ৮৬ কোটি টাকার সংস্কার এবং পুণ:সংস্কার কাজ গোপন আতাতের মাধ্যমে চিহ্নিত ঠিকাদারদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গত ১৭ অক্টোবর চার কোটি টাকার প্রাক্কলিত সংস্কার ও পুন:সংস্কারের দু’টি কাজ ঘুপচি প্রক্রিয়ায় বন্টনের আয়োজন সম্পন্ন করার অভিযোগ রয়েছে। একাজের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আগ্রহী ঠিকাদারদের কাছে টেন্ডার সিডিউল বিক্রি করা হয়নি।
সংক্ষুব্ধ ঠিকাদাররা জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও সিডিউল কিনতে পারেননি। তিনি তাদের বলেছেন, মন্ত্রী-এমপির নির্দেশনা অনুযায়ী মনোনীত ঠিকাদারদের কাছে নির্দিষ্ট সংখ্যক সিডিউল বিক্রি করা হয়েছে। কোন ঠিকাদার সিডিউল বিক্রির অনিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের এক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের ভবিষ্যতে কোন কাজ দেয়া হবেনা বলে তিনি হুমকি দেন। এছাড়া কালো তালিকাভুক্তির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, একের পর এক পিলেচমকানো দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন দোর্দন্ড প্রতাপশালী এই কর্মকর্তা। দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে তৎপর হলেও তার অনিয়ম আরো বহুগুনে বেড়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা জানিয়েছেন।
বেশ ক’জন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ কর্মকর্তা ঢাকা জোনকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। তার পছন্দসই ঠিকাদারদের নিয়ে গড়া সিন্ডিকেটের বাইরে অন্যদের কাজ পাবার সুযোগ নেই। তার বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্ণীতির প্রতিবাদ করায় ঠিকাকাজ বন্টন কমিটির আহ্বায়ক সহকারী প্রকৌশলী সেলিম হোসেনকে চ্যালেঞ্জ দিয়েই  বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে অন্যত্র বদলি করতে সক্ষম হন। তার স্বাক্ষর ছাড়াই মির্জা নজরুল ইসলাম সব কাজ অবৈধভাবে বন্টন করছিলেন। দাপ্তরিক কাজে স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্বারোপ করে পুরস্কারের পরিবর্তে সেলিম হোসেন হয়রানিমুলক বদলির শিকার হওয়ায় প্রতিবাদী অন্য কর্মকর্তারাও আতংকে রয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোজোনের আওতায় মহানগরী এলাকায় প্রতি বছর উন্নয়ন ও সংস্কার কাজে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে বড় অংকের কাজগুলো নানা কৌশলে নিজ দখলে রাখেন মির্জা নজরুল। তার ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান মির্জা কন্সট্রাকশনের নামে ওইসব কাজের ঠিকাদারী ব্যবসা বাগিয়ে নিচ্ছেন। মির্জা কনস্ট্রাকশনের কাগজপত্রে মির্জা আমিনুল ইসলামের নাম থাকলেও এর নেপথ্য  মালিক মির্জা নজরুল বলে জানা গেছে। সূত্র মতে, গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ৫ নম্বর টেন্ডার  গ্রুপের ডব্লিউডি-১ মোহাম্মদপুর কমার্স কলেজ, ডব্লিউডি-২ শ্যামপুর শেখ কামাল কলেজ, ডব্লিউডি- ৩ হাজারীবাগ শেখ রাসেল স্কুল ডব্লিউডি-৪ এবং হাজারীবাগ শেখ ফজিলাতুননেসা কলেজ সংস্কার কাজের টেন্ডার জালিয়াতি করা হয়েছে। গোপনে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়ায় এর নির্মাণ স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে লালবাগে ইডেন সরকারী মহিলা কলেজ অভ্যন্তরে সীমানা প্রাচীর পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার কাজের জালিয়াতি ধামাচাপার কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। প্রায় ৬০ লাখ টাকার চার গ্রুপের এ ঠিকা কাজের একটি পায় মির্জা কনস্ট্রাকশন। নামকাওয়াস্তে রঙের কাজ করেই সংস্কার ও পুনঃসংস্কারের সিংহভাগ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে বিভাগীয় কর্মকর্তার পোষ্যের ঠিকাকাজে অংশ নেয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যে কোন টেন্ডারে আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে বিভাগীয় কর্মকর্তা কোন পোষ্য কিংবা আত্মীয়কে কাজ  দেবেন না বলে অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মির্জা নজরুল নিয়ম  ভেঙ্গে  আত্মীয়দের প্রতিষ্ঠানের নামে নিজেই কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ৬ তলা ভীত বিশিষ্ট ৪ তলা ভবন এবং তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মান উন্নয়নে বেসারকারী কলেজসমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজের মান নিয়ে। প্রতিটি নতুন ভবন ৮ তলা ভীত বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন। এছাড়াও বেসরকারী মাদ্রাসাসমূহের একাডেমি ভবন নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৩৩টি মাদ্রাসা অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি নতুন ভবন ৪ তলা ভীত বিশিষ্ট একতলা ভবন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের ৪ তলা হতে ৬ তলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমূখী সম্প্রসারণসহ নিচতলা হতে ৬ তলা পর্যন্ত ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল, ওয়ার্ড ইন্টেরিয়াল ডেকোরেশন,অডিটোরিয়াম,সীমানা প্রাচীরসহ গেট নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দের উল্লেখযোগ্য অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, যে সকল প্রকল্পের কাজ ৩০ থেকে ৫০ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে সে সব প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ ইতিমধ্যে সরকারী কোষাগার থেকে উঠানো হয়েছে। গত অর্থ বছরের জুন মাস পর্যন্ত ঢাকামেট্রো জোনে প্রায় ৭০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৪৪২টি সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ হয়। প্রথম দুই মাসেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ কোটি টাকার  সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ বণ্টন করা হয়েছে।
এছাড়া এ জোনে বেশিরভাগ উন্নয়ন বা সংস্কার কাজের টেন্ডার হয় গোপনে। সিডিউল বিক্রিও হয় নির্ধারিত ঠিকাদারদের কাছে। লটারির মাধ্যমে দারদাতা নির্বাচনের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। তিনি নিয়ম বহির্ভূতভাবে অখ্যাত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তার পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেন। তার পছন্দের পত্রিকার তালিকায় রয়েছে  দৈনিক শক্তি, দৈনিক ভোরের আওয়াজ, দৈনিক ব্যানার, ডেইলি ইভিনিং নিউজ ইত্যাদি।
বঞ্চিত কয়েকজন ঠিকাদার জানান, ঢাকা মেট্রোজোনে  কাজে ঠিকাদারদের চাহিদানুযায়ী সিডিউল বিক্রি হচ্ছে না। একেকটি কাজের জন্য ৫’শ থেকে এক হাজার সিডিউল বিক্রির কথা। সেখানে মাত্র ৫ থেকে ১০টি সিডিউল বিক্রি করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে সিডিউল বিক্রি না হওয়ার কারণে সরকার প্রতি বছর মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা না থাকায় নিন্মদর হচ্ছে ইচ্ছে মাফিক । গুনগত মানসম্পন্ন কাজ হচ্ছে না।
অভিযোগ রযেছে, এর আগে ঝিনাইদহে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকাকালীন মির্জা নজরুল ইসলাম দুর্নীতির আখড়া গড়ে  তোলেন। সেখানে থাকাকালে ঠিকাদারদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তার পারসেন্টেজের বিষয়টি উঠে আসে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরই কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ওই সময় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিলো। এছাড়া নেত্রকোনায় দায়িত্ব পালনকালে অনিয়মের কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্য তাকে প্রত্যাহারের জন্য ডিও লেটার দিতে বাধ্য হন। অধিদপ্তরে এ ব্যাপারে তদন্ত কার্যক্রম চললেও তা ধামাচাপার চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে।
সাভার জোন পিছিয়ে নেই
এদিকে সাভার জোনও পিছিয়ে নেই অনিয়মে। এ জোনে প্রায় ১০ কোটি টাকার ঠিকাকাজ গোপন প্রক্রিয়া ও সমঝোতার ভিত্তিতে পূর্ব নির্ধারিত ঠিকাদারদের মধ্যে বন্টনের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। ১৩ গ্রুপ করে এ কাজ বন্টনের কথা। আজ ১৯ অক্টোবর দরপত্র  খোলার দিন ধার্য আছে। সাধারণ ঠিকাদাররা এ পর্যন্ত কোন সিডিউর  কেনার সুযোগ পাননি।  পূর্র্বনির্ধারিত ঠিকাফার্মের নামে অল্পসংখ্যক সিডিউল বিক্রির কথা জানা গেছে। সাভার জোনের নির্বাহি প্রকৌশলী  জিয়াউল হক উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে গোপনে কাজ বন্টনের চক্রান্ত করায় সাধারণ ঠিকাদারদের মধ্যে অসন্তোষ এবং ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × 2 =