আজ রংপুরের আকাশে উড়েছিল টেইলার্স মাস্টার মকবুলের তৈরি প্রথম পতাকা

0
1542

স্টাফ রিপোর্টার ॥
আজ ২৩ মার্চ। আজকের এই দিনে সেই সময়ে তিনকোনা বিল্ডিং(আজকের পায়রা চত্বরা) মোড়ে রংপুর প্রেসক্লাবের ছাদে প্রয়াত তিন সাংবাদিক আব্দুল মজিদ, নওয়াজেশ হোসেন খোকা এবং মোজাম্মেল হকের নির্দেশনায় লালিয়া টেইলার্সের মালিক টেইলার্স মাস্টার মকবুল হোসেনের তৈরিকৃত প্রথম বাংলাদেশের পতাকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরে প্রথম যে বাংলাদেশের পতাকাটি ওড়ানো হয়েছিল তিনিই বানিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক পতাকাটি। সেই মেশিনেই তিনি এখনও সেলাই করেন এ্যপ্রোন। তিনি জানিয়েছেন ৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার  মনো বেদনার কথা।

মকবুল হোসেন  জানান, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। তখন দুপুর ১ টা। তখন পায়রা চত্বরটির নাম ছিল তিনকানিয়া দালান মোড়। এই বিল্ডিংয়েই ছিল রংপুর প্রেসক্লাব। প্রেসক্লাব থেকে তৎকালীন সাংবাদিক আব্দুল মজিদ, নওয়াজেশ হোসেন খোকা এবং মোজাম্মেল হক আমার টেইলার্সে আসলেন। তারা আমাকে একটি ডিজাইন দিয়ে বললেন, দ্রুত হুবুহু পতাকা তৈরি করে দিতে। আমি তাদের দেয়া ডিজাইন মতো একটি পতাকা তৈরি করলাম। তাতে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ম্যাপ। প্রায় ৩ ঘন্টায় পতাকাটি তৈরি করে ওই তিন সাংবাদিকসহ আমি প্রেসক্লাবের ছাদে গিয়ে পতাকাটি উড়ালাম। কিছুক্ষণ পর আর্মির লোকজন এসে নামলো তিনকোনা বিল্ডিং মোড়ে। সোজা তারা আমার লালিয়া টেইলার্সে আসে। টের পেয়ে আমি সটকে পড়ি। তারা এসে কর্মচারীদের বলে, ‘টেইলার মাস্টার কিধার গিয়া, উসকো পাকাড়কে লেয়াও। আভি হামারা সাথ লেজাউঙ্গি ক্যান্টনমেন্ট।’ আমাকে না পেয়ে তারা দুই থান কালো কাপড় দেয়। সেটা দিয়ে পতাকা বানিয়ে দেয়ার জন্য আদেশ করে। আমার কর্মচারীরা তাদের কিছু পতাকা বানিয়ে দেয়। এরপর সেখানে ঘনঘন আসা শুরু করে আর্মিরা। পরের দিনও এসে আমাকে খুঁজে যায়। তৃতীয় দিনও আমাকে না পেয়ে আর্মিরা আমার শালবনের বাসায় যায়। সেখানেও আমাকে না পেয়ে তারা আমার পরিবারের সদস্যদের শাসিয়ে আসে। এসময় তারা আমার পরিবারের সদস্যদের বলে, ‘মাস্টার কা থার কওন হ্যায়ও উশালা ফ্লাগ বানাত হায়,  হাম উসকো দেখ লেঙ্গা।’
মকবুল হোসেন বলেন, হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমার দোকানে বসেই আমরা কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ নেই। সবার সাথে পরামর্শ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য আমি কালিগঞ্জের কাকিনা হয়ে সিতাই দিয়ে ভারতের দিনহাটায় যাই। যেখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করি এবং সেখানে মিত্রবাহিনী ও বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পোশাক তৈরি করাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করি। এরপর ৬ নং সেক্টরের অধীনে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জে ও আদিতমারীর চলবলা, রুদ্রেশ্বর, হারিসর, তুষভান্ডার এলাকায় মিত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করি।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর আমি পুনরায় ফিরে এসে আমার যুদ্ধ বিধস্ত লালিয়া টেইলার্সকে আবারও গড়ে তোলার চেষ্টা করি। এই টেইলার্সের আয় দিয়েই রংপুরে ফিরে আসা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা শুরু করি। তাদের অনেককেই পুনর্বাসন করি। ১৯৭২ সালের ১১ মে রংপুর কালেক্টরেট মাঠের বিশাল সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। সেই মঞ্চে সাংবাদিক আব্দুল মজিদ, মোজাম্মেল হক ও নওয়াজেশ হোসেন খোকাসহ আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় হই এবং বঙ্গবন্ধুকে ফুলের শুভেচ্ছা জানাই। এসময় সাবেক এমপি বীরমুক্তিযোদ্ধা মরহুম সিদ্দিক হোসেনের মালিকানাধীন মকুসষ ভবনের পাশে লুক টেইলার্সে একসাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে চা খেতে খেতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প করার সৌভাগ্যও হয়েছিল আমার।
মকবুল হোসেন বলেন, এখন আমার চোখের সামনে এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু হচ্ছে। অনেকে যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ বেয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ৪৬ বছরেও আমি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তো দূরের কথা স্বীকৃতিটুকুও পেলাম না। তিনি বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম প্রকাশের জন্য ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর কাছে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য উপাথ্য দিয়ে আবেদন করি। এরপর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবরে ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারী আবেদন করে যোগাযোগ রাখি। এরপর ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি (ডিজি নং ১১৬৩৯৬)। কিন্তু কোন কাজ না হওয়ায় ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিবের বরাবরে সকল তথ্য উপাথ্য দিয়ে আবেদন করি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক আবার আবেদন পত্রে ‘যাছাই করে ব্যবস্থা নেবেন’ বলে ফুট নোট দিলেও তিনি এখন পর্যন্ত আমার নাম গেজেটে প্রকাশ পায় নি। আমি আমার আবেদনের সাথে ভারত প্রেরিত নং ৩৮০৪৯, সূচক  ৮৫-৪৮-৯০০৫১ সংগ্রহ করে সেটিও আবেদনের সাথে সংুক্ত করি।
প্রথম পতাকা বানানো এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ১৯৫৮ সালে আমি লালিয়া টেইলার্স প্রতিষ্ঠিত করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পতাকা বানানো ও মুক্তিযুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়লেও আল্লাহর রহমতে
আমি বেঁচে থাকলেও আমার চাচা মোশাররফ হোসেন, চাচাতো ভাই বাপাদ এবং জামাই মোস্তফাকে আর্মিরা নির্মমভাবে হত্যা করে। আমি একটি শহীদ পরিবারের সন্তান। এখন আমি বয়সের ভারে ন্যুয। চোখেও সেরকম দেখি না। বঙ্গবন্ধু কণ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার অনুরোধ যে উদ্যোম নিয়ে পতাকা তৈরি করেছিলাম, যে উদ্যোম নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। সেই উদ্যোমের স্বীকৃতিটুকু আমি চাই। সেই স্বীকৃতি নিয়ে মরে যেতে পারলেও আমার জীবনের কোন দু:খ থাকবে না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

13 − 9 =