ব্রাহমা নিয়ে বেকায়দায় রাজশাহীর প্রান্তিক খামারিরা

0
1720

মাংস উত্পাদনে প্রসিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের প্রান্তিক খামারিরা। এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া ৪৫৯টি বাছুরের অধিকাংশই চলে গেছে ফড়িয়াদের কব্জায়। খামারিরা বলছেন, এ জাতের গরুর জন্য প্রয়োজনীয় খাবার জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দ্রুত মোটাতাজা করতে গিয়ে অতিরিক্ত খাবার দিচ্ছেন খামারিরা। এতে গরমের কারণে বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকিও। এরই মধ্যে মারা যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। ফলে অধিকাংশ খামারি এখনই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোর জেলার আট উপজেলায় শুরু হয়েছে ব্রাহমা পালন। এ পর্যন্ত ওই তিন জেলার ৪০০ প্রান্তিক খামারির গোয়ালে এসেছে ২৫৬টি এঁড়ে এবং ২০৩টি বকনাসহ ৪৫৯টি বাছুর। অতিরিক্ত খাবারের জোগান দিতে না পেরে এবং দু-একটি মারা যাওয়ায় আতঙ্কে এরই মধ্যে দুই শতাধিক খামারি গরু বিক্রি করে দিয়েছেন।

রাজশাহী কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ব্রাহমার বীজ দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে ১ হাজার ৪৬০টি। এর মধ্যে রাজশাহীর পবায় ৮২, পুঠিয়ায় ১৩২, চারঘাটে ৮৪, নাটোর সদরে ১৩৭ ও সিংড়ায় ১৭, নওগাঁ সদরে ৩১০, আত্রাইয়ে ৩১১ এবং রানীনগরে ৩৮৭টি। জুনের পর থেকে নতুন করে প্রজনন করা হয় আরো ৯৫টি। দুটি দেশীয় জাতের গাভী আছে প্রতি উপজেলা থেকে এমন ২০০ জন করে খামারির তালিকা তৈরি করে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়। এদের মধ্যে প্রতি উপজেলায় প্রায় ৫০ জন করে খামারির গাভী ব্রাহমা বাছুর প্রসব করেছে। মাংসের ঘাটতি পূরণে পরীক্ষামূলক ‘বিফ ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট’ নামে এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২৪ মাস বয়সেই ব্রাহমা গরু ৮০০ কেজি থেকে ১০০০ কেজি মাংস উত্পাদনে সক্ষম, যেখানে দেশী গরু থেকে উত্পাদন হয় সর্বোচ্চ ৪০০ কেজি। এরই মধ্যে উত্পাদনের পদ্ধতি, সফলতা ও জনপ্রিয়তা বিস্তৃত হতে শুরু করেছে।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার প্রান্তিক খামারি ইদ্রিস আলীর গোয়ালে রয়েছে ১৬ মাস বয়সী ব্রাহমা জাতের ষাঁড়। সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা সেটি পরিদর্শন করে ওজন ধরেছেন ৩১৬ কেজি। প্রায় সাড়ে ৩০০ কেজি ওজনের আরেকটি ব্রাহমা ষাঁড় রয়েছে পবা উপজেলার তকিপুর এলাকার খামারি রাশেদুল ইসলামের গোয়ালে। এ দুটি গরু জেলায় কোরবানিযোগ্য বলে ধরে নিচ্ছে প্রাণিসম্পদ দপ্তর।

রাজশাহী বিমানবন্দর-সংলগ্ন মহাসড়কের পাশে রাশেদুল ইসলামের খামার। চারটি গাভী রয়েছে তার খামারে। রয়েছে দুই বছর বয়সের একটি এবং ছয় মাস বয়সের আরেকটি ব্রাহমা গরু। মুদি দোকানের পাশাপাশি ছোট পরিসরে এ খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, অন্য গরুর সঙ্গে ব্রাহমা গরু দুটি পালন করছেন। প্রথম দিকে ঘাস, খড়, ক্ষুদ, ভুষি খাওয়াতেন। কোরবানি সামনে আসায় যোগ করেছেন চিটাগুড় ও মিষ্টি আলু। প্রথম বছর সব মিলিয়ে এ ষাঁড়ের খাবার বাবদ খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। শেষ ছয় মাসেই খরচ করেছেন ১ লাখের মতো। কোরবানি পর্যন্ত নিতে দেড় লাখ টাকা খরচ পড়ে যাবে। বিক্রি হবে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। ব্রাহমা পালনে লাভের আশাই করছেন তিনি।

তবে অন্য খামারিদের জন্য সুখবর বয়ে আনতে পারেনি এ ব্রাহমা। প্রান্তিক খামারি আজিমুদ্দিনের মোটাতাজা হওয়া এক বছরের একটি ষাঁড় মারা গেছে। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলেছেন, গরমে হিটস্ট্রোকে মারা গেছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্কে আশপাশের অনেক খামারি ব্রাহমা গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নিয়মিত নজরদারির অভাবও রয়েছে বলে অভিযোগ খামারিদের। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওই উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইসমাইল হক।

অতিরিক্ত খাবার সরবরাহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন নওগাঁর রানীনগর এলাকার প্রান্তিক খামারিরা। খাবারের ঘাটতি হওয়ায় অনেকের গরুর বৃদ্ধিও কমে যাচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ খামারি বিক্রি করে দিচ্ছেন ব্রাহমা গরু। এসব গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মৌসুমি খামারি ও ফড়িয়ারা। তারা লালন-পালন করে তুলছেন বাজারে অথবা কোরবানির জন্য অপেক্ষা করছেন।

রানীনগর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন সেলিম উদ্দিন। বর্তমানে তিনি কর্মরত নাটোর সদর প্রাণিসম্পদ দপ্তরে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা দেশী গাভী পালন করেন তাদের অধিকাংশই স্বল্পপুঁজির খামারি। তাদের পক্ষে ব্রাহমা পালন সত্যিই কষ্টসাধ্য। ফলে বাধ্য হয়ে সময়ের আগেই বিক্রি করছেন গরু। শুরুতে এ প্রকল্পে খামারিদের প্রণোদনা দেয়া হতো। সেটি এখন বন্ধ। আবারো প্রণোদনা চালু করতে পারলে ভালো হয় বলে তার অভিমত।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাজশাহীর রাজশাহী কৃত্রিম প্রজননকেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আহমেদ ইকবাল। তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত খামারিদেরই শুধু সিমেন সরবরাহ করা হয়েছে। কথা রয়েছে, ২৪ মাসের আগে এ গরু বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু তার আগেই খামারিরা বিক্রি করে দিচ্ছেন। যদিও উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পাঠানো প্রতিবদনে গরু বিক্রির বিষয়টি উঠে আসে না।

প্রকল্প শুরুর আগে মাঠ নিরীক্ষা হয়নি স্বীকার করে আহমেদ ইকবাল বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। খামারি নির্বাচনেও নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তার পরও তারা কাজ শুরু করেছেন। সফলতা আসছে ধীরে ধীরে। খামারিদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়া গেলে ব্রাহমা পালনে গতি আসবে বলে মত দেন তিনি।

রাজশাহীর অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আখতার হোসেন জানান, এবার রাজশাহীতে কোরবানি হতে পারে প্রায় ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪৮টি পশু। এর মধ্যে ৫১ হাজার ১৬৬ ষাঁড়, ৬ হাজার ৮৭০ বলদ, ২ হাজার ৫২৪ গাভী ও  ৪৯৬ মহিষ। বাকি ২ লাখ ৯২ হাজার ৮৮২ ছাগল এবং ২ হাজার ৭৫৭ ভেড়া। মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ ১৬ হাজার ৮২১ খামারির গোয়ালে রয়েছে এসব পশু। গত বছর রাজশাহীতে কোরবানি করা হয়েছে ৪৮ হাজার গরু এবং ২ লাখ ৯৫ হাজার ছাগল। এবার লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে ৫ শতাংশ।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, ক্ষতিকর স্টেরয়েড দিয়ে গরু মোটাতাজা করছেন মুনাফালোভী মৌসুমি খামারিরা। তবে এখনো এমন কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন রাজশাহীর অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন। তিনি বলেন, স্টেরয়েড ব্যবহার ঠেকাতে বরাবরের মতো এবারো আগে থেকে সচেতনতায় খামারি, মসজিদের ইমাম ও কসাইদের নিয়ে সভা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতামূলক প্রচারণা চলছে। কোরবানির পশুর হাটে প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরেনারি সার্জনের নেতৃত্ব টিম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 − seven =