Site icon Aparadh Bichitra

রাজনীতি অর্থনীতি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : অর্থনীতি ও রাজনীতির মধ্যে কে বড় কে ছোট, কে কার দ্বারা কতখানি প্রভাবিত, উদ্বুদ্ধ কিংবা পরিচালিত হয় তা আজও বিশ্বব্যাপী কোথাও খোলাসা করা সম্ভব হয়নি। কেননা যুগে যুগে স্থান, পাত্র ও প্রক্রিয়াভেদে অর্থনীতি ও রাজনীতি অধিকাংশ সময় অনিবার্যভাবেই সমতালে ও সমভাবনায় এগিয়ে চলছে। কেননা মনে হয়েছে বড্ড পরস্পর প্রযুক্ত এরা। যেন দুজনে দুজনার। যদিও অনেক সময় এটাও দেখা গিয়েছে রাজনীতি অর্থনীতিকে শাসিয়েছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে: আবার অর্থনীতি রাজনীতিকে অবজ্ঞার অবয়বে নিয়ে যেতে চেয়েছে বা পেরেছে। গত শতকে রাজনৈতিক অর্থনীতির ধারণা বেশ ব্যাপ্তিলাভ করে। এ কথা ঠিক বহমান বর্তমান বিশ্বে, ক্রমশ, অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। কেননা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে শুরু করে, সকল পর্যায়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদন, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সবকিছুতেই নীতি নির্ধারণে অর্থ নিয়ামক ভূমিকায়। সিদ্ধান্ত হয় আর্থিক প্রভাবের ও সক্ষম সম্ভাবনার নিরীখে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব নীতি-নির্ধারণ করে অর্থনৈতিক জীবনযাপনকে জবাবদিহির আওতায় এনে সুশৃঙ্খল, সুশোভন, সুবিন্যস্ত করবে এটাই ঠিক। কিন্তু নীতি-নির্ধারক যদি ভক্ষক হয়ে নিজেই অর্থনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টির কারণ হয়, তখন আমজনতার অর্থনৈতিক জীবনযাপন পোষিত (ভধপরষরঃধঃবফ, ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃবফ) হওয়ার পরিবর্তে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নীতি-নির্ধারক নেতৃত্ব যদি নিজস্ব তাগিদে ও প্রয়োজনে নিজস্ব উপায়ে সম্পদ ও স্বার্থ সংগ্রহে আত্মসাতে ব্যাপৃত তখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের এখতিয়ার ও ক্ষমতা খর্ব হয়। আইনসভায় নীতি-নির্ধারক বিধি-বিধান তৈরি করবেন সকলের জন্য প্রযোজ্য করে, নিরপেক্ষভাবে, দুরদর্শী অবয়বে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগে নীতি-নির্ধারক নিজেই নিজেদের স্বার্থ অধিকমাত্রায় দেখতে থাকেন তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, প্রতিপক্ষরূপী বিরুদ্ধবাদিদেরকে বঞ্চিত করতে স্বেচ্ছাচারী অবস্থান গ্রহণ করেন তখন ওই আইনের প্রয়োগে নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় সন্দেহ তৈরি হয়। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আমজনতার আগ্রহ নেতিবাচক মনোভাবে চলে যায় ও সর্বোপরি সকলে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মসূচি পরিপালিত হবে দলমত নিরপেক্ষভাবে, কারও প্রতি অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ সুযোগ-সুবিধা অধিকার আদান-প্রদান, নীতি নিয়মকানুন ও আইনশৃঙ্খলার বিধানাবলি বলবৎ, প্রয়োগ ও বাস্তবায়নযোগ্য হবে না এটাই সকল নাগরিকের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক সত্য ও প্রথা। কিন্তু যদি দেখা যায় ক্ষমতাসীন নীতি-নির্ধারক তা শুধু নিজের, নিজের এলাকায়, গোত্রে, দলে ও কোটারির মধ্যে নাগরিক অধিকারের সকল বরাদ্দ বিভাজন সীমিত করে ফেলে এবং বিরুদ্ধবাদীদের বঞ্চিত করায় স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে ওঠে তাহলে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য পূরণ ব্যর্থ হতে পারে। এখানে, এরূপ পরিবেশে রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে, নিয়ন্ত্রক ও নিয়ন্ত্রিতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি উৎপাদনে সম্পদে সংসার সমাজসহ নীতি-নির্ধারককে যেমন একটি রূপময়, বেগবান, ঐশ্বর্যম-িত ও আনন্দঘন সক্ষমতা দান নির্মাণ করবে আবার রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারক এর ভুল ও পদক্ষেপের দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকে, সমৃদ্ধির সক্ষমতা ও সুযোগকে তেমন প্রশ্নবিদ্ধ-পক্ষপাতযুক্ত করে ফেলে, দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ হয় বিপন্ন এবং এর ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা শুধু দ্বিধাগ্রস্ত নয়, হয় বাধাপ্রাপ্তও।
গণতন্ত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের। নির্বাচনের ইশতিহারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচির নানান প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে রাজনৈতিক দল। ভোটারকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ক্ষমতায় গেলে এ জাতীয় উন্নয়নের বন্যায় ভেসে যাবে দেশ। কিন্তু নেতৃত্ব তা যদি যথাযথ বাস্তবায়ন করতে না পারে তাহলে ব্যর্থতার ও অভিযোগের তীর নিক্ষিপ্ত হয় খোদ রাজনীতির প্রতি নেতিবাচকতার দিকেই।
অতীতে রাজা-বাদশাদের রাজনীতি আবর্তিত হতো মসনদে আহরণকে কেন্দ্র করে; সে সময় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র হতো সেভাবেই। মসনদ আহরণের ধ্রুপদ মুখ্য প্রেরণা ও শক্তির উৎস ও লক্ষ্য থাকত অর্থ প্রতিপত্তি উদ্ধার ও অধিকার। এই ভারতবর্ষে কোম্পানি আমলে এদেশ প্রশাসিত হয়েছিল সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে। ছিল নানান খাজনা রাজস্ব আদায়কামী অর্থনীতি। ১৯৭৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করেছিলেন তা ছিল মধ্যসত্ব¡ভোগী জমিদারের মাধ্যমে রায়তের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্যই। কিন্তু প্রজার অর্থনৈতিক উন্নয়ন, তাদের প্রতি দায়িত্বপালন সবই কোম্পানির মুনাফামুখী দৃষ্টিভঙ্গিতে উপেক্ষিত থাকে। ফলে রায়ত বা প্রজাকূল অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার পদে পদে নানান বঞ্চনার শিকার হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের মূল কারণ যতটা না সামাজিক কিংবা ধর্মীয় তার চাইতে বেশি ছিল অর্থনৈতিক। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। সে দায়িত্ব পালনের জন্য নাগরিকদের ওপর কর আরোপ প্রথা প্রবর্তন করা হয়, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকে একটা কাঠামোর মধ্যে আনা হয়। এসবই কিন্তু মূলত এবং মুখ্যত রাজনীতিকে অর্থনীতির সঙ্গে সাযুজ্য সামঞ্জস্য আনার জন্য, দায়বদ্ধ পরিবেশ সৃজনের জন্য। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি অঞ্চলকে নিয়ে একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলে দেখা গেল পূর্বাঞ্চল নানান বৈষম্যের, অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও পক্ষপাতিত্বকরণের শিকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত ও মূল কেন্দ্রবিন্দু এই অর্থনৈতিক বণ্টন বৈষম্য দূরিভূত করার আকাক্সক্ষাকে কেন্দ্র করে। সে সময় প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক অর্থনীতির চিন্তাচেতনা সামনে চলে আসে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম…’ উচ্চারণ করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় বিশেষ করে পাকিস্তানের সমাজ সংসার থেকে পৃথক স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অর্জনের মূল কারণ ও প্রেরণা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি তথা শোষণ ও বণ্টন বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি। প্রাক্তন পাকিস্তানি রাজনীতির ব্যর্থতা ছিল আঞ্চলিক উন্নয়ন তথা স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার ব্যাপারে সকল অঞ্চলে সুষম, সুশোভনীয় সুশীল আচরণে অপারগতা।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান