Site icon Aparadh Bichitra

ভাষাহীন প্রাণীকূল কেন অবহেলিত ?

মোঃ আবদুল আলীমঃ
এক সময় আরব দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। জনৈক খলিফা ঘোষণা দিলেন, বিত্তশালীরা যেন দুভিক্ষ কবলিত লোকদের জন্য সাহায্যের সামগ্রী নিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছে দেয়। অর্থাৎ খলিফা দুর্ভিক্ষের আঘাতে জর্জরিতদের মধ্যে সাহায্য বিতরন করবেন। এক বিত্তশালী তার উটে চড়ে অনেক সামগ্রী নিয়ে দীর্ঘ পথ বেয়ে খলিফার কাছে পৌঁছলেন। খলিফা দেখলেন সাহায্য সামগ্রী বহনকারী উটের অবস্থা করুন। তিনি সাহায্য নিয়ে আসা উটের মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার উটের এ অবস্থা কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে উটটি এখনই মারা যাবে।” উটের মালিক খলিফাকে জানালেন যে উটটি ধীর গতিতে চলছিল। তাই সাহায্য বোঝাই এ প্রাণীকে তাড়াতাড়ি খলিফার কাছে পৌঁছনোর জন্য মারতে মারতে আনা হয়েছে। খলিফা সাথে সাথে বললেন,“চলে যাও তুমি, তোমার সাহায্য আমি রাখবো না।” লোকটি এর কারন জিজ্ঞাসা করলে খলিফা বললেন,“যে ব্যক্তি আল্লাহ‘র সৃষ্টি জীবের প্রতি দয়ালু নয় তার সাহায্য তিনি রাখবেন না। এরপর লোকটির শত অনুরোধ সত্বেও খলিফা তার সাহায্য গ্রহণ করেননি এবং তা তৎক্ষনাৎ ফেরত দেন। পৃথিবীর সকল ধর্ম স্বীকার করে যে আল্লহ‘র সৃষ্ট জীবকে ভলবাসলে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন। বৌদ্ধ ধর্মে তৃপিটক পাঠ করার পর “পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখি হোক “বলে সমাপ্তি টানা হয়। আমাদেরই সেবায় নিযুক্ত চারপাশের প্রাণীরা অনেক অবহেলা, অত্যাচার ও জুলুমের শিকার। রাস্তার পাশে বসে থাকা কুকুরটির দিকে তাকিয়ে কেউ কি বলতে পরবেন তার ক্ষুধার জালা কেমন? এক গলি থেকে বেরিয়ে আরেক গলিতে চলে যাচ্ছে বিড়ালটি যে কতদিন অভুক্ত রয়েছে তার হিসেব রাখার মত চিন্তা বা সময় আমাদের কারও নেই। একেবারেই নেই। শুধু কুকুর ও বিড়ালই নয়, প্রতিদিন প্রকাশ্য দিবালোকে অসংখ্য প্রাণী নির্মম নির্যাতনের শীকার এবং এধরনের নির্যাতন ভয়াবহ। কে করবে এর প্রতিকার? তবে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভুহীন ও অযতেœ বেড়ে ওঠা প্রাণীদের প্রতি মায়া ও মমতার হাত প্রসারিত করছেন এমন অল্প কয়েকজনের পরিচয় পওয়া যাচ্ছে। তাদের একজন সোহানা জাহান। ঢাকার স্বামীবাগে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। ১৫ বছর বয়স থেকে যিনি ভাষাহীন প্রাণীদের ব্যাথায় ব্যাথিত। তার সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি বাধা বিপত্তির শক্তিশালী দেয়াল ভেঙে রক্ষা করছেন বীপদে পড়া প্রাণীদেরকে। পাড়া মহল্লা ও সমাজ থেকে কত রকমভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে সোহানাকে। প্রাণী বান্ধব সোহানা জাহানকে অবহেলিত ও অত্যাচারিত প্রাণীদের কাছ থেকে দূর সরিয়ে রাখার জন্য তার ওপর জীবনের হুমকি পর্যন্ত চলে এসেছে। কিন্তু তিনি থামেননি। প্রাণীকুলের প্রতি তার অগাধ মমতার কারনে অনেক সেলিব্রিটি তাকে অনেক সম্মান করেন। প্রাণী বান্ধব এই ব্যক্তিত্বের সাথে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার অনেক উঁচু মর্যাদার ব্যক্তিদের সাথে মত বিনিময় করার প্রমাণও রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রমাণ তার বাসার পাশের প্রাণীগুলো তাকে প্রভু হিসেবে মানে। বাসা থেকে স্কুলে যাবার সময় দুইটি কুকুর তার সাথে স্কুল পর্যন্ত যায় ও স্কুলের গেটে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়ার সময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। সোহানা জাহান যখন তার কোন অসুস্থ আতœীয়কে দেখতে রাজধানী মার্কেটের পাশে সালাহউদ্দিন হাসপাতালে যান তখনও বেশ কয়েকটি কুকুর তার রিকশার পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকে ও হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। শুধু তাই নয় তিনি যতক্ষন হাসপাতালে অবস্থান করেন ততক্ষন প্রাণীগুলো প্রভুর জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। তিনি বের হলে তার সাথে আবার রিকশার পেছনে পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ফেরত আসে। ভাষাহীনের প্রভু ভক্তির এমন উদাহারন আমাদের দেশে বিরল। সোহানার পিতা মোঃ আবু তারিক। তিনিও ছিলেন পশু প্রাণীদের প্রতি অনেক সদয়। সদয় থাকাটাই স্বাভাবিক। কারন তিনি সরকারের উচ্চ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা ছিলেন এবং কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন সৎ ও অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। সততার সাথে মমতার রয়েছে যোগসূত্র। পিতার গুণাবলি মেয়ের কাছে প্রবাহিত হয়েছে। পিতা মোঃ আবু তারিক এক সময় একটি বানর পালতেন। বানরটিকে সোহানা ও তার পিতা উভয় মিলে অনেক যতœ করতেন। সেই থেকে পশু প্রাণীদের প্রতি তাদের মমতার সূত্রপাত। ঢাকা চিড়িয়াখানার খাঁচায় আটকানো প্রাণীদের দুরাবস্থার যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা লোমহর্ষক। তার দেয়া বর্ণনা মতে দর্শনার্থীদের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্যই যেন চিড়িয়াখানার প্রাণীদেরকে খাঁচায় আটকানো হয়েছে। খাঁচায় বন্ধি প্রাণীদেরকে ঠিকমত খাবার ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। অনেক প্রাণী ছোট একটি খাঁচায় একাকি নির্মম বন্ধি জীবন কাটাচ্ছে অথচ সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সেদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। এভাবে বেশি দিন চলতে দেয়া যায় না। সোহানা জাহান এ প্রতিবেদককে জানান প্রায়ই দেখা যায় চায়ের দোকানের পাশে শুয়ে বা বসে থাকা একটি কুকুর প্যাকেটে ঝুলানো বিস্কুট ও রুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন কেউ কি নেই ক্ষুধার্ত কুকুরটিকে একটি বিস্কুট বা ছোট একটি রুটি দেয়ার মতো? দু একটি রুটি হলেই কুকুরটি একদিন অভুক্ত না থেকে দিন কাটাতে পারে। তিনি বেদনার সাথে আরও জানান প্রায়ই দেখা যায় ছয়/সাতটি মুরগী একসাথে রশি দিয়ে পা বেঁধে উত্তপ্ত রস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে বিক্রির উদ্দেশ্যে। এ অবস্থায় মুরগীগুলো একটুও নড়তে পারে না। ক্ষুধা ও তৃষœায় মুরগীগুলোর শরীর থরথর করে কাপতে থাকে। তা ছাড়া রশি দিয়ে বেঁধে রাখার কারনে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে মুরগীগুলোর পা লাল হয়ে যায়। প্রকাশ্য দিবালোকে এতবড় অনিয়মের প্রতিকার করার কোন লোক, বিভাগ, প্রশাসন সবই অনুপস্থিত এদেশে! তিনি আক্ষেপের সূরে বলেন, “ভাষাহীনদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে প্রচলিত আইন আছে তার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না কেন?” একজন উদীয়মান প্রতিবাদি মেয়ে সোহানা জাহানের পক্ষে একা এতবড় অন্যায় ও জুলুমের প্রতিকার করা অন্তত এদেশে সম্ভব নয়। কারন কুসংস্কার ও নারী বিদ্বেশী আমাদের এই অন্ধকার সমাজে সোহানাদের হাতকে আরও শক্তিশালী করতে হলে চাই শক্তিশালী সংগঠন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রিভেনসন অব ক্রয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট এর বাস্তবায়ন। তবেই আমাদের ভাষাহীন, অবহেলিত ও প্রতিনিয়ত নির্যাতিত প্রাণীকূল সোহানার স্নেহের স্পর্শে বেড়ে ওঠবে ও বেঁচে থাকবে।