শ্রমিকদের জন্য করা হটলাইন বা অভিযোগ কেন্দ্র

0
579

প্রচারের অভাবে কাজে আসছে না শ্রমিকদের জন্য করা হটলাইন বা অভিযোগ কেন্দ্র। শ্রমিকদের যেকোনো অভিযোগ শোনার জন্য তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ এই হটলাইন (০১৭৩০৪৪২২১১) চালু করলেও বেশির ভাগ শ্রমিক এ সম্পর্কে কিছু জানেন না। গত পাঁচ বছরে এই নম্বরে ফোন করে কোনো শ্রমিক অভিযোগ জানাননি। অথচ বিভিন্ন জরিপে বলা হচ্ছে, তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে শারীরিক, মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছেন।

শ্রমিকদের অভিযোগ, বিচার পাবেন না ভেবেই তাঁরা কোথাও অভিযোগ করেন না। সেই সঙ্গে চাকরি হারানোর ভয় তো রয়েছেই। অন্যদিকে, বিজিএমইএ বলছে, অভিযোগ পাওয়া মাত্র তারা ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোশাকশিল্প কারখানার চার শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। কিন্তু সে অনুযায়ী অভিযোগ করেন খুব কম। কারখানার কর্মপরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা ও মজুরি সমস্যার বাইরে শ্রমিকদের, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হওয়া এই খাতের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ভাষায়, তাঁদের কথা শোনার কেউ নেই। এক শ্রমিক বলেন, ‘প্রতিদিনই কাজের খুঁত ধরে। কেউ কেউ যা-তা বলে গালি দেয়। অনেক সময় মারধরও করে।’তাহলে অভিযোগ করেন না কেন? প্রশ্ন করলে এক শ্রমিক বলেন, ‘দেখা গেল, অভিযোগ করলাম কিন্তু বিচার পাইলাম না। উল্টা চাকরিই চইলা গেল। তখন কী করব?’নির্যাতনের শিকার শ্রমিকেরা যেন অভিযোগ জানাতে পারেন, সে জন্যই হটলাইন চালু করে বিজিএমইএ। উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে শ্রমিকদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে শুনে সে ব্যাপারে যেন ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তবে শ্রমিক বা শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যেই এই বিষয়ে কোনো প্রচার নেই। শ্রমিকদের বেশির ভাগই ২৪ ঘণ্টা চালু থাকা এই হটলাইনের খবর জানেন না। যাঁরা জানেন, তাঁরাও অভিযোগ করলে কাজ হবে কি না, বিচার পাবেন কি না, সেই ভরসা পান না। বিজিএমইএ জানিয়েছে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের নানা অসন্তোষের বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য হটলাইনে ফোন করার আহ্বান জানানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত ওই হটলাইনে শ্রমিকেরা অভিযোগ করেননি। ওই হটলাইনে অভিযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বিজিএমইএর অতিরিক্ত সচিব (শ্রম) রফিকুল ইসলাম গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছরেও নারী-পুরুষ কোনো শ্রমিকই এখানে কোনো অভিযোগ জানাননি।’বিষয়টি নিয়ে প্রচারের অভাব রয়েছে কি না, তা জানতে রফিকুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর ২০১৩ সালে সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বিজিএমইএ এই হটলাইন চালুর ঘোষণা দেয়। তবে তৃণমূল পর্যায়ে হটলাইন প্রচারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে তিনি স্বীকার করেন। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে পোশাকশিল্প কারখানার নারী শ্রমিকদের নানা বেদনার কথা উঠে এসেছে। এতে নারী কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে মৌখিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আইসিডিডিআরবির সহায়তায় ‘মেজারিং দ্য অ্যাফেক্ট অব হাররেসপেক্ট: এন ইন্টারভেনশন অ্যাড্রেসিং ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট ফিমেল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ইন ফোর ফ্যাক্টরিজ অব বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার চারটি কারখানার নারী শ্রমিকদের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। গবেষণায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশে পোশাকশিল্প কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নারী নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা কারখানার মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার হাতে নির্যাতনের শিকার হন। এত-সংখ্যক কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হলেও হটলাইনে কোনো নারী শ্রমিককে যোগাযোগ করার কথা শোনা যায়নি। বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার দাবি করেন, পোশাকশিল্প কারখানাগুলোয় শ্রমিকেরা নানা চাপের মধ্যে কাজ করেন; বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা। তাঁরা কারখানায় মৌখিক, শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার হন হরহামেশা। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ তো নিত্যনৈমিত্তিক। প্রথম আলোকে এই নেত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক নারী শ্রমিক কারখানায় হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানান। প্রকাশ্যে তাঁরা কিছু বলতে ভয় পান।’ এসব নিয়ে বিজিএমইএর হটলাইনসহ কারখানাগুলোয় কোনো অভিযোগ করা হয় কি না, তা জানতে চাইলে তাসলিমা আখতার বলেন, হটলাইন নিয়ে কোনো প্রচার নেই। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে এত সহজে চাকরি চলে যায় যে বেশির ভাগই অভিযোগ করার সাহস পান না। আবার অনেকে ‘হয়রানি’ বিষয়টি সম্পর্কেও ভালো বোঝেন না। তাঁরা মনে করেন, কারখানায় কাজ করলে গালিগালাজ শুনতেই হবে। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মতে, আগে ননকমপ্লায়েন্স কারখানাগুলোতে মধ্যপর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাতে শ্রমিক লাঞ্ছনার কথা শোনা যেত। গত এক যুগে এ অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন ননকমপ্লায়েন্স কারখানার সংখ্যা হাতে গোনা। কারখানায় বায়ারদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের অবস্থা বুঝতে হুটহাট পরিদর্শন করা হয়। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিক হয়রানির তথ্য পেলে কারখানাই চলবে না। নারী শ্রমিকদের বিষয় তো আরও সংবেদনশীল। তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের খারাপ ব্যবহার করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা আছে।’ শ্রমিকেরা চাকরি হারানোর ভয়ে কারখানায় অভিযোগ করেন না, এমনকি বিজিএমইএর হটলাইনেও যোগাযোগ করেন না—এর কারণ কী? জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আগের মতো পরিস্থিতি নেই বলেই হয়তো অভিযোগ কম। তাই হয়তো তাঁরা অভিযোগ করেন না। তবে কেউ অভিযোগ করলে তাঁদের চাকরি হারানোর ভয় নেই। এখন শ্রমিক সংগঠনগুলোও অনেক শক্তিশালী। শ্রমিকদের বিষয়টি খুব সচেতনভাবে খেয়াল রাখা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen − fourteen =