মো. কামরুজ্জামান। বয়স ২৮। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মরণব্যাধি ব্লাড ক্যানসারে ভুগছেন তিনি। গেল বছরের ১৪ই নভেম্বর ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হন। ৯০১ ওয়ার্ডের ২৫ নম্বর বিছানায় শুয়ে কী যেন ভাবছেন তিনি। পাশেই তার স্ত্রী বসা। ৩১শে জানুয়ারি সরজমিন ওয়ার্ডে গেলে তার স্ত্রী জানান, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার স্বামীর ব্লাড ক্যানসার হয়েছে। তাদের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। শুধু কামরুজ্জামান নন, দেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যায় ৯১ হাজার।
বাংলাদেশে ১৬ থেকে ১৭ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেন। ক্যানসারের রোগী বেড়েই চলছে। দিন দিন রোগী বাড়লেও চিকিৎসা নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে রোগী এবং চিকিৎসকদের। বর্তমানে দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রতি বছর নতুনভাবে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয় ২৬ হাজার ৭৯২ জন। এরমধ্যে ১১ হাজার ৯৫৬ জন মহিলা জরায়ুর ক্যানসারে এবং ১৪ হাজার ৮৩৬ জন মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। মারা যায় প্রায় ১৪ হাজার।
বিশেজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রায় তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে। আবার অনিরাপদ খাদ্যগ্রহণকেও চিকিৎসকরা ক্যানসারের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন। কৃষিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার খাদ্যদ্রব্যকে করে তুলছে অনিরাপদ। এর ওপর রয়েছে ফলমূল ও মাছে ফরমালিনের ব্যবহার। বায়ুদূষণকেও ক্যানসার বিস্তারের আরো একটি কারণ বলে মনে করেন তারা। বাতাসে সীসার পরিমাণ বৃদ্ধি ক্যানসারের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গবেষণা বলছে, ক্যানসার আক্রান্ত প্রতি ২ লাখ মানুষের জন্য দুটি রেডিও থেরাপি সেন্টার প্রয়োজন। কিন্তু দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি রেডিও থেরাপি সেন্টার আছে ১৫টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এরমধ্যে সরকারি আছে ৯টি, বেসরকারি ৬টি। যার সবগুলোর মেশিন আবার সমভাবে সচল নয়। জানা গেছে, মোট ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৬০ শতাংশই পুরুষ। পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৩ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে, লিপ অ্যান্ড ওরাল ক্যানসারে ১২ শতাংশ, অন্ননালির ক্যানসারে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া আছে পাকস্থলি, হস্কিন লিম্ফোমা, মূত্রনালি, লিভার ও লিউকোমিয়া ক্যানসার। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। বিশেজ্ঞরা জানান, ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীরাই ক্যানসারে আক্রান্ত হন সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে থেমে নেই শিশুরাও। শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত লিউকোমিয়ায়।
সমপ্রতি এক সেমিনারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ভেজাল খাবার, শস্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, ধূমপানসহ নানা কারণে মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। জরায়ু ও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অনেক মা-বোন মারা যান। তারা জানেনই না যে তাদের জরায়ু বা স্তনে ক্যানসার হয়েছে। এজন্য এই প্রাণঘাতী রোগের বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রতিরোধের দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। একই অনুষ্ঠানে বিএসএমএমইউ’র ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ক্যানসারের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
স্বাস্থ্য অধিপ্তরের ২০১৬ সালে প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুযায়ী জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটউট ও হাসপাতালে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দেশে ক্যানসার আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০১২ সালে ৩০২০ জন এবং মারা গেছে ৬৫ জন, ২০১৩ সালে ৩০৪৫ জন এবং মারা গেছে ১১৮ জন, ২০১৪ সালে ৪০৫৭ জন এবং মারা গেছে ১২৮ জন, ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৮৫ জনে এবং মারা গেছে ১৭৪ জন। হাসপাতালটিতে বহির্বিভাগ দিয়ে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা সেখানে ২০১২ সালে ছিল ৫৯ হাজার ২২১ জন এবং পাঁচ বছর বয়সের নিচে এমন শিশুর সংখ্যা ১৮০৩ জন। এই সংখ্যা ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার ৩৭ জন এবং পাঁচ বছর বয়সের নিচে এমন শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৯১০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসারের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে তিনি জানান, হঠাৎ করে গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। শরীরের যেকোনো জায়গায় চাকা হলে তা বৃদ্ধি পাওয়া। অস্বাভাবিক রক্তপাত। যেকোনো ঘা না সারা। পায়খানা ও প্রসাবের অভ্যাসের পরিবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে খুসখুসে কাশি থাকা। দীর্ঘদিনের জ্বর। কারণ ছাড়া ওজন অতিরিক্ত পরিমাণে হ্রাস পাওয়া। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ অনকোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ আকরাম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সারা বিশ্বে ক্যানসার রোগী বাড়ছে। বাংলাদেশেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৩০ সালে এটা ১২ শতাংশে ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য খাত এজন্য প্রস্তুত না। সচেতনতার অভাবে রোগের একেবারে শেষ পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসে মানুষ। ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগীর রেডিয়েশন থেরাপি দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আনুমানিক ১৬ থেকে ১৭ লাখ ক্যানসার আক্রান্ত রোগী আছে। জনগণের চাহিদার তুলনায় যন্ত্রপাতিসহ সবকিছুই অপ্রতুল। কিছু লোক বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেলেও অনেকে আধুনিক মাত্রার চিকিৎসা পাচ্ছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। দেশে স্বাস্থ্যবীমাও নেই। সরকারকে এদিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুলাহ তালুকদার রাসকিন তার এক প্রবন্ধে বলেন, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি বছর ৮২ লাখ মানুষ ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ৪০ লাখ ঘটে অকালমৃত্যু, ৩০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। ২০১৬-২০১৮ এই তিন বছরের জন্য এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘উই ক্যান, আই ক্যান’। আমরা পারি, আমি পারি। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ সম্মিলিতভাবে সফল করতে পারি। আবার ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই পারি ক্যানসারের বোঝা লাঘবে ভূমিকা রাখতে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ওপর ক্যানসারের ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবে সবারই সুযোগ আছে ব্যবস্থা নেয়ার। যেকোনো দেশে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য দরকার ক্যানসারে আক্রান্তের হার, মৃত্যুর হার, কারা কোন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে সেই সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান। এর জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যা ভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকির জন্য গঠিত উচ্চ পর্যায়ের ‘জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল’ প্রায় অকার্যকর। দীর্ঘদিন এই পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের ৪টি গুরুতবপূর্ণ উপাদান রয়েছে। প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যানসার নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে ক্যানসারের জন্য বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো ও চিকিৎসা সরঞ্জামের পেছনে। ক্যানসার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। প্রাথমিক প্রতিরোধের প্রধান উপাদান ক্যানসারের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ও টিকাসহ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রটি সবচেয়ে অবহেলিত। সরকারের কিছু উদ্যোগ আছে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে, সমন্বয়ের অভাবে তা দৃশ্যমান প্রভাব ফেলতে পারছে না। বেসরকারি সংগঠনগুলো মূলত সচেতনতা কার্যক্রমকে জনগণের কাছাকাছি নিইয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশেও নানা উদ্যোগে ক্যানসার দিবসটি পালন করা হবে।