জীবনমানের ব্যয় ও দ্রব্যমূল্যের চরম বৃদ্ধিতে সংসার খরচ মেটাতে এখন অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। আর তাই খরচের কিছুটা জোগান পেতে ভাড়া বাসায় অনেকেই দিচ্ছেন সাবলেট ভাড়া। তবে সাবলেট ভাড়াটিয়ারাই যেন এখন অনেকের জীবনে কাল হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে সংসার, হতে হচ্ছে খুন। সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, এ যেন নিজের ঘরে শত্রুকে নিয়ে বসবাস করার মতো। সম্প্রতি রাজধানীর নানা এলাকার বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, পাঁচটি বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপনের মধ্যে অন্তত একটি সাবলেটের বিজ্ঞাপন।
রাজধানীতে সাবলেট-ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাসের প্রচলন শুধু সরকারি কলোনিতেই সীমাবদ্ধ নেই। বস্তি এলাকা থেকে শুরু করে গুলশান, বনানী ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোতেও এর প্রচলন শুরু হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। রাজধানীর অনেক এলাকায় এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। যারা নিজেদের থাকার জন্য ভাড়া করা ফ্ল্যাটে তাদের চাহিদার অতিরিক্ত রুমটি সাবলেটে ভাড়া দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। কারণ জনবহুল এই নগরজীবনে বর্তমানে এটিও এক ধরনের চাহিদায় পরিণত হয়েছে। যার বদৌলতে একদিকে ভাড়াটিয়া ও উপভাড়াটিয়া (সাবলেট দাতা ও গ্রহীতা) উভয়েই আর্থিক এবং পারস্পরিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। একই সঙ্গে অনেকের মিলছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। সাবলেট ভাড়া আপাত দৃষ্টিতে সহায়ক হলেও এটিই অনেক সময় জীবনহানি ঘটায়। অর্থাৎ সাবলেট ভাড়া অতঃপর পরকীয়া। পরবর্তী সময়ে হত্যাকাণ্ড। একই কারণে রাজধানীর বাড্ডায় প্রাইভেটকার চালক জামিল শেখ ও মেয়ে নুসরাতকে করা হয় হত্যা। তাদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় সাবলেট থাকা ভাড়াটিয়া শাহীন মল্লিক ও জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বাবাকে হত্যা করতে দেখে ফেলায় মায়ের পরকীয়া প্রেমিকের হাতে খুন হয় ৯ বছরের শিশু নুসরাত জাহান জিদনী। গত বছরের ১ নভেম্বর রাতে উত্তর বাড্ডার ময়নারবাগের ভাড়া বাসায় নুসরাতকে শ্বাসরোধে ও তার বাবা জামিল শেখকে মাথায় আঘাত করে খুন করা হয়। জামিলের স্ত্রী আরজিনা ও তার কথিত প্রেমিক শাহীন মল্লিক হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জামিলের সংসার ছেড়ে সাবলেট ভাড়াটিয়া শাহিনের সঙ্গে ‘ঘর বাঁধার’ স্বপ্ন দেখছিলেন আরজিনা। পথের কাঁটা সরাতেই তারা খুন করেন বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বাড্ডা থানার এসআই সাখাওয়াত হোসেন। রঙ মিস্ত্রি শাহীন নিহত জামিলের ভাড়া বাসার একটি কক্ষে স্ত্রী মাসুমাকে নিয়ে সাবলেট থাকতেন। হত্যায় জড়িত সন্দেহে শাহীনের স্ত্রী মাসুমা ও বন্ধু কোয়াজকেও গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়াও পরকীয়ার জেরে স্ত্রী শামীমা আক্তার হ্যাপি হত্যায় নিহতের স্বামী মুকুল হোসেন মোল্লা ও পরকীয়া প্রেমিকা লাভলী আক্তার নীলুফাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, মুকুল তৎকালীন সময়ে গ্রেফতার হলে পুলিশকে জবানবন্দিতে জানান বিয়ের আগে মুকুল সাভারের গেণ্ডায় নীলুফার বাসায় সাবলেট ভাড়া করে থাকতেন। সাবলেট থাকার সময় তার সঙ্গে মুকুলের শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই বাসার একটি অংশে তার একটি প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিও ছিল। নীলুফা তার স্বামীর সঙ্গে দুই মেয়ে নিয়ে ওই বাসায় বসবাস করতেন। একপর্যায়ে আসামি মুকুল বিয়ে করে একই এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। তখনও তাদের পরকীয়া চলছিল। নীলুফা মুকুলকে প্রায়ই বলতেন বউ নিয়ে তার সামনে ঘোরেন এটা তার ভালো লাগে না। একদিন তিনি দু’জনের একজনকে খুন করবেন। ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারি নীলুফা ভিকটিম লাভলীকে নিয়ে মুকুলের কারখানায় যান। সে সময় কারখানায় বিদ্যুৎ না থাকায় কর্মচারীদের কেউ ছিল না। কারখানায় ঢুকেই নীলুফা ভিকটিমের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ধরেন। মুকুল দৌড়ে গিয়ে ভিকটিম লাভলীর পা মাটির সঙ্গে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, নানা কারণে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হয়ে পড়ছে। এ কারণে অবিশ্বাস ও অপ্রীতিকর ঘটনা বাড়ছে, যা অনেক সময় খুনোখুনিতে রূপ নিচ্ছে। পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানোর পর মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তখন নিজের সন্তানকেও শত্রু ভাবতে শুরু করে। এর পরই সন্তানকে খুন করে। তিনি বলেন, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রতা থেকে বের হতে হবে। স্বামী ও স্ত্রীকে একে অপরের সময় দিতে হবে। নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবাসন-ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষের বসবাস প্রক্রিয়াও দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। ষাটের দশকেও সাবলেট ব্যবস্থার সঙ্গে ঢাকার পরিচয় ঘটেনি। অথচ এখন এ ব্যবস্থা নগরবাসীর প্রয়োজনেই যেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর যেমন অনেক মন্দ দিক আছে, তেমনি আছে ভালো দিকও। একসময় সাবলেটের বিষয়টি হাস্যকর ও বিব্রতকর হলেও বর্তমানে এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন নগরবাসীর একটি অংশ। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় এখন সাবলেটের বেশ ছড়াছড়ি বললে বাহুল্য হবে না। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ ব্যাপারে বলেন, দেশের মানুষের প্রতি বছরই জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৮.৪৪ ভাগ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ৭.১৭ ভাগ। এভাবে বছর বছর জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যার ফলে বাধ্য হয়েই অনেকে আর্থিক চাহিদা মেটাতে বর্তমান সময়ে সাবলেট বাসা ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে। চাকরিজীবী ইমরান আলী। সপরিবারে থাকেন রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায়। ভাড়া বাসায়। ছোট পরিবার হলেও তিন বেডরুমের বড় ফ্ল্যাট। নতুন ফ্ল্যাটে উঠেই তিনি উপলব্ধি করলেন, তার পরিবারের সদস্য সংখ্যার তুলনায় একটি রুম বেশি আছে। তাই ফ্ল্যাট লোকেশনের সঙ্গে নিজের মোবাইল নম্বর যুক্ত করে মহল্লার গলির মুখে ঝোলালেন সাবলেটের বিজ্ঞাপন। যাতে লেখা: একটি ছোট পরিবারের জন্য একটি রুম সাবলেটে ভাড়া দেয়া হবে। ইমরান আলী বলেন, রাজধানীতে বাসা ভাড়া দিতেই বেতনের ৬০ শতাংশ ব্যয় হয়। বর্তমানে যে বাসায় থাকি তার ভাড়া ১৬ হাজার টাকা। একার পক্ষে এত ভাড়া দেয়া সম্ভব হয় না, তাই ৬ হাজার টাকায় এক ফ্যামিলিকে সাবলেট দিয়েছি। এ বিষয়ে মালিবাগে সাবলেট ভাড়া নেয়া মামুনুর রশিদ বলেন, কম বেতনে চাকরি করি। যে বেতন পাই সেই বেতন দিয়ে পুরো একটি বাসা ভাড়া নেয়া সম্ভব না। তাই সাবলেট বাসা নিয়েছি। ফ্যামিলি সদস্য বলতে আমি আর আমার স্ত্রী। তাই অন্য একটি ফ্যামিলির সঙ্গে এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকি।