সরকারের ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে

0
1494

ঢাকা মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস। এই নগরে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে জনসাধারণ প্রধানত প্রাইভেটকার, মোটরচালিত গাড়ি, টেক্সি ক্যাব ও রিকশা ব্যবহার করে থাকেন। সঙ্কুলান কম হওয়ায় একই রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করে। ফলে যানবাহনের গতি দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং রাস্তায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে অনেক কর্মঘণ্টা। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ যা মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। হুমকির মুখে পড়ছে পরবর্তী প্রজন্মও। নগর গবেষণা ও উন্নত বিশ্বের সড়ক ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রবর্তন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ট্রাফিক সেফটির ব্যবহার উন্নয়নের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

বিষয়টিকে সামনে রেখে ঢাকায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের নিমিত্তে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকা পরীক্ষামূলকভাবে চারটি ইন্টার সেকশনের উন্নয়নসহ অত্যাধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম পর্যায়ে রাজধানীর পল্টন, ফুলবাড়িয়া, মহাখালী ও গুলশান-১ এ ইন্টারসেকশনের কাজ শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। যে উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, তার মধ্যে রয়েছে- এ ধরনের আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম প্রবর্তনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও ট্রাফিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ এবং গাড়িচালক ও পথচারীদের সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ। প্রকল্পটি ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়। পরে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির মেয়াদ বাড়ানোসহ প্রভৃতি কারণে টিটিপি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। গত বছর জুলাই মাসের ১৩ তারিখে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক সংশোধিত টিটিপি অনুমোদন দেয়। সেই অনুযায়ী প্রকল্পে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয় জুন ২০১৫ সাল থেকে জুন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং জাইকার মধ্যে ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজ তদারকির জন্য ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নামে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এতসব কাজের হিসাব এখনো কাগজে-কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবিক কাজের নেই কোনো ‍উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক কর্মকর্তা  বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমরাও হতাশ। যেমন আজও ফুলবাড়িয়া প্রকল্প এলাকায় অবৈধ হকার উচ্ছেদ এবং যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করা যায়নি। ফলে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং দক্ষিণ ট্রাফিক বিভাগের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। সিস্টেমটি পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত ক্যামেরাসহ যন্ত্রপাতি জাইকার মাধ্যমে জাপান থেকে সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি জাইকা কর্তৃক ক্রয়কার্য সম্পন্ন না হওয়ায় মূল আইটিএস যন্ত্রাংশ সরবরাহ বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে আবারও প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। বর্তমান প্রকল্পটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। এই প্রকল্পের সাফল্য বিবেচনায় এনে ঢাকা শহরের যানজট নিরসন এবং সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে অন্যান্য ইন্টারসেকশনসমূহ সিস্টেমের আওতায় আনার বিষয়ে জাইকা কর্তৃক আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণীত নকশা অনুযায়ী কাজ সম্পূর্ণ করতে প্রকল্পটি সফল করা না গেলে সমগ্র ঢাকা শহরে আইটিএস সিস্টেমের মাধ্যমে ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নে জাইকার সহযোগিতার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। প্রকল্পটি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলামের দাবি চুক্তিস্বাক্ষরের পরের মাসেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ শুরুর পর নকশা প্রণয়ন ও দরপত্র দাখিল প্রস্তুত শেষে যাবতীয় কাজ মোট চারটি প্যাকেজের মাধ্যমে সম্পাদনের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়।  পরে অধিকতর ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দরপত্রটির মূল্যায়ন শেষে কাজের জন্য চারটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের চারটি ইন্টারসেকশনে অত্যাধুনিক ইনটেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম দ্বারা ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে পরামর্শ কর্তৃক প্রণীত নকশা অনুযায়ী যাবতীয় ইলেকট্রিক্যাল কাজ মোট ১টি প্যাকেজের মাধ্যমে সম্পাদনের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। ইতোমধ্যে প্রকল্পের গৃহীত দরপত্রসমূহ মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। প্রকল্পের সিগন্যালিং কাজের জন্য যেসব ইকুইপমেন্ট জাইকা কর্তৃক প্রদান করা হবে তা আসার পর ইলেকট্রিক কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ৪ ইন্টারসেকশনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণীত নকশা অনুযায়ী তিনটি ইন্টারসেকশনে পূর্ণ কাজ শুরু হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি ইন্টারসেকশনে বিদ্যমান মিডিয়ামসহ অন্যান্য স্থাপনা অপসারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী ইন্টারসেকশনসমূহের মিডিয়াম তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। মহাখালী ও গুলশান-১ এর ইন্টারসেকশনসমূহের ফুটপাত ও অন্য উন্নয়নমূলক কাজ চলমান রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রকল্পের সর্বমোট চারটি পিআইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে বেশকিছু সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ গৃহীত হয়। প্রকল্পটি একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। ফলে এতে সফলতা অর্জন করতে পারলে ঢাকা শহরের বাকি সকল ইন্টারসেকশন উন্নয়নসহ সিস্টেম স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়া সম্ভব হবে বলে অনুষ্ঠিত প্রথম পিএসসি সভায় উল্লেখ করা হয়। উক্ত প্রকল্পে ডিএমপির সুপারিশক্রমে সিস্টেম মেমোরি পরিচালনা করার ব্যবস্থা রাখা হয় পিআইসি সভায়। পরে উক্ত সদস্যদের মতামত অনুযায়ী টিপিপি সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রকল্পের পল্টন ও ফুলবাড়িয়া ইন্টারসেকশনে সরকার কর্তৃক দখলকৃত স্থান উদ্ধার করতে হবে। এতে সভায় উপস্থিত অন্য সদস্যরাও মত দেন। মতিঝিল ও পল্টন জোনের এসি মো. সারোয়ার হোসেন  বলেন, ‘প্রকল্পটি দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ট্রাফিক এরিয়াগুলোতে অধিক যান চলাচল অবকাঠামোগত ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পটি যথাযথ সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারলে গোটা রাজধানীতেই ট্রাফিক উন্নয়নের কার্যক্রম হাতে নেবে সরকার। বুয়েটের শিক্ষক ও গবেষক প্রফেসর ড. ছাইফুল ইসলাম  বলেন, আমি যতদূর জানি, প্রকল্পটির পরীক্ষামূলক চারটি ইন্টারসেকশনের কাজ শেষ করতে পারলে পুরো ঢাকা সিটি করপোরেশনেই এ ধরনের সয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম চালুর বিষয়ে সহযোগিতা করবে জাইকা। ‘আর তাতে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত (ট্রাফিক এক্সিডেন্ট ডাটা) এবং রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যাগত তথ্য (ট্রাফিক ভলিউম ডাটা) খুব সহজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করা সম্ভব হবে।’ এর ফলে আশা করা হচ্ছে, এ ধরনের সিস্টেম যে এলাকায় থাকবে তার আশপাশে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমবে। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে ইন্টারসেকশনগুলোতে পুলিশ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের পক্ষে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করা সম্ভব হবে। এতে কোনো চালক যদি দুর্ঘটনা করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তাকে শনাক্ত করা সহজ হবে। কিন্তু সরকার এ ধরনের ভালো উদ্যোগের পেছনে যে গড়িমসি করছে, তাতে এ কাজ কতদিনে সম্পন্ন হবে তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা সিটি করপোরেশন, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এবং ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে একটা সমন্বয় দরকার। এটা ছাড়া এসব প্রকল্প নেয়া হবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

14 − three =