মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন
স্বাধীনতার এতোটি বছর অতিক্রম করলেও বাঙালি জাতির প্রত্যাশা পূরণে শত বাধার সৃষ্টি হয়েছে। মূলতঃ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে প্রধান উৎসই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য।
পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিদ্যমান বৈষম্য দানা বাঁধতে-বাঁধতে এক সময় রূপ নেয় আন্দোলন থেকে চরম আন্দোলনে। বাঙালিরা দাবী করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীনতা। ন্যায্য অধিকার আদায় করাই ছিল সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। যার প্রতিশ্র“তিতে বাঙালি জাতি বহু আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে বাঙালি জাতির পরম হিতৈষী বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আহ্বানে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলার গণমানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি সোহরাওয়ার্দী ময়দানে লাখো-লাখো জনতার সামনে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি নিধন শুরু করে নিষ্ঠুরভাবে। ২৫ মার্চ তারা অতর্কিতভাবে ঢাকা শহরে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে হাজার-হাজার নর-নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অত্যাচারে ১ কোটি বাঙালি পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীসহ জামায়াতের হাতে ৩০ লাখ বাঙালির জীবন দিতে হয়। বাংলার লাখো-লাখো মানুষের বৃহত্তর ঐক্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাঙালি জাতির মধ্যে যে স্বপ্ন জাগরিত হয়েছিল, তা বাস্তবে রূপ নেয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ দিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে এবং বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক দেশটি স্থান করে নিতে সক্ষম হয়।
পাকি বাহিনী বাঙালিদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন এবং শেষ মুহূর্তে চলে যাওয়ার সময় যে হত্যাযজ্ঞ করেছিল, তা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শত-শত বার আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছিল। বিশ্বের অন্য কোন জাতির বাঙালিদের মতো এতো আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়নি। পাকিস্তান স্বাধীনতার পর পরই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় আবদার, আর অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। ওরা সর্বপ্রথম আঘাত হানে বাঙালিদের মাতৃভাষার ওপর। ওরা চেয়েছিল বাঙালিদের মাতৃভাষার ওপর আঘাত হেনে আজীবন তাদের তাবেদার করে রাখতে। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবীতে অগণিত শহীদদের ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালিরা যে ইস্পাত কঠিন শপথ নেয়, তার প্রতিধ্বনিই ছিল ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র যুদ্ধ। পাকিস্তান সরকার শত চেষ্টা করেও বাঙালিদের ইস্পাত কঠিন বৃহত্তর ঐক্য ভাঙ্গতে পারেনি। যারাই বাঙালিদের আন্দোলন ও সংগ্রামে সম্মুখভাগে ছিলেন, তাদেরকে ভারতের চর, ইসলামের দুশমন বলে অপবাদ দিয়েছে। কিন্তু বাঙালিরা ওদের কথায় বিশ্বাস করেনি এবং ওই বৃহত্তর ঐক্যের ফসলই আজকের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করলেও বাঙালিদের মধ্যে একটা অসম্পূর্ণতা ছিল। এর কারণ ছিল, বাঙালিদের পরম হিতৈষী বন্ধু এবং স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বিশ্ব জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাকিস্তান সরকার স্বসম্মানে বাঙালিদের কাছে ফেরত পাঠাবে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পা রাখলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। এ দিন লাখো-লাখো জনতা তাঁকে বরণ করে নেয় এবং সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে নব-রূপে গড়ে তোলার জন্য দীপ্ত শপথ নেন। শুরু হলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার বিভিন্ন রকম কর্মযজ্ঞ। বড়ই দুর্ভাগ্য; যখন জাতির পিতা তাঁর স্বাধীন দেশকে গড়ে তুলতে সদা ব্যস্ত, তখনই বাঁধা সৃষ্টি করতে শুরু করলো- হক, তোয়হা, দেবেন শিকদার ও সিরাজ শিকদারসহ দেশবিরোধীরা এদের চেয়েও বেশী ক্ষতি করতে শুরু করলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নামক একটা উগ্র শ্লোগানধারী রাজনৈতিক দল। তারা উগ্র হঠকারী এবং সস্তা শ্লোগানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে দেশবাসীর মনে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি করতে লাগলো।
এ দলটি গঠনের সাথে সাথে স্বাধীনতা বিরোধীদের যেমন জাসদে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়, তেমনি হঠকারী চরিত্রের ব্যক্তিরাও স্থান করে নেয়। মূলতঃ এ দলটির কর্মই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধীতা করা। তারা ব্যাংক-বীমা, হাট-বাজার ও থানা-পুলিশ ফাঁড়ি ইত্যাদিতে লুটপাট করতে শুরু করলো। এমন কোন অপকর্ম নেই, যা তারা করেনি। দেশের মানুষ যখন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেছে, জাসদ তখনই করেছে দেশবিরোধী যত সব কার্যকলাপ। জাসদ এর অত্যাচার-অনাচার আর হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে দেশবাসী চরমভাবে অতিষ্ট হয়ে পড়ে। এ দলটি সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্তি করে ফেলে। জাসদ এর সদস্য তাহের নামক সেনাসদস্য সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন রকম উস্কানী বা ভুল বুঝিয়ে যা ক্ষতি করে, তা সত্যিই অপূরণীয়।
আমাদের এ সদ্য স্বাধীন দেশে যখন অতি প্রয়োজন ছিল সকলে মিলেমিশে দেশকে পুনর্গঠন করা, জাসদ নামক দলটি করলো তার সম্পূর্ণ উল্টো। এদের কারণেই যে অপূরণীয় ক্ষতি হবার, তাই হয়ে গেল! এর ফলশ্র“তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে জাতির জনককে জীবন দিতে হয় এবং তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন চিরতরে ধূলিস্যাত হয়ে যায়। আজ দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন, কি অপরাধে বা কোন কারণে জাতির জনককে হত্যা করা হলো এবং তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশবাসী পেলোটা কি…………..!!??
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল-বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের মধ্য দিয়ে দেশকে বিশ্বের দরবারে দাঁড় করানো কিন্তু তিনি দেশ চালাতে গিয়ে যা দেখলেন, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তাঁর পাশের লোকদের আচরণ বা কার্যকলাপে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত এবং দুঃখ পেলেন। তিনি একটি জনসভায় অতি দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বললেন, “…………………. সবাই পায় স্বর্ণের খণি, আর আমি পেয়েছি চোরের খণি…………।” তাঁর লক্ষ্য ছিল-স্বাধীন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সোনার বাংলায় প্রতিষ্ঠা করা। তাই তিনি চোর-ডাকাত, কালোবাজারি, দুর্নীতিবাজ ও কালোটাকার মালিকদের সায়েস্তা করে শোষিতের বাংলাদেশ গড়ার জন্য নতুন কর্মসূচি হাতে নিলেন। যে দলকে তিনি তাঁর রক্তবিন্দু দিয়ে গড়ে তুলেছেন, সে দলকে বিলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন একটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল গঠন করলেন। এ দল গঠনের পর তিনি দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষকে নতুন দলে যোগদানের আহ্বান জানালেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী অন্যতম শরীক দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর সভাপতি জননেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মণিসিংহসহ অনেক দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা।
বড়ই দুর্ভাগ্য, জাতির জনকের হত্যার পর ক্ষমতা গ্রহণকারী মীরজাফরের দোসর হারামজাদা খুনী মোস্তাক বেশী দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তাকে অতি সুকৌশলে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সেনাসদস্য জিয়াউর রহমান। মূলতঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মূল হত্যাকারী এবং পরিকল্পনাকারী জিয়াউর রহমান। এ ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে দেশ ও স্বাধীনতা বিরোধী যত সব কার্যকলাপ শুরু করে দেয়। তার সাথে যুক্ত হয় গণধিকৃত জামায়াতসহ স্বাধীনতা বিরোধী সকল চক্র। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করে বিদেশে দূত প্রেরণ করে। গণধিকৃত জামায়াতের আমীর বাংলার মীরজাফর গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে নিয়ে আসে। তিনি আইয়ূবী কায়দায় ধর্মকে ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো জাতিকে বিপথে পরিচালিত করতে থাকে। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানেও হাত দিয়ে ইচ্ছেমতো সংশোধনী আনয়ণ করেন।
বাঙালিরা যখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে বা সুযোগ এসেছে, তখনই তাদের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত শুরু হয়েছে। স্বাধীন দেশের মানুষ তাদের দেশ ইচ্ছেমতো গড়ে তুলবে বা উন্নয়ণের পথে নিয়ে যাবে তাইতো স্বাভাবিক কিন্তু দেশী-বিদেশীরা চক্রান্ত করে তা বাস্তবায়ণ হতে দিলো না। দেশকে পুনরায় সামরিকতন্ত্রের পথে নিয়ে গেল। জিয়া-এরশাদ রাজনীতির যে ক্ষতি করেছে বা জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে তা অপূরণীয়…………..।
প্রচলিত গণতন্ত্র দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের কোন মঙ্গল সম্ভব নয়। জাতির জনক যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন তাইই ছিল সঠিক পথ। যদি দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের মঙ্গল বা উন্নতি করতে চান, তাহলে অবশ্যই জাতির জনকের প্রত্যাশিত কর্মসূচি বাস্তবায়ণ করতে হবে।
“ধর্মের ঢোল আপনা-আপনি বাজে, এ কথা সর্বজনবিদিত।” তাই জিয়াউর রহমান বেশী দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তাদের লোকের হাতেই জিয়াউর রহমানকে পরলোকে যেতে হয়।
জাতির জনককে অকালে চলে যেতে না হলে, আজ বাংলাদেশটা হতো বিশ্বের মধ্যে উন্নয়ণের মডেল। আজ বিশ্ববাসী মালয়েশিয়াকে উন্নয়ণের মডেল হিসেবে দেখছে, জাতির জনকের অকাল মৃত্যু না হলে বাংলাদেশ হতো একটা উন্নয়ণের মডেল রাষ্ট্র।
লেখক : মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন, সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
ফোন # ০১৭১০৮৮৩৪১৩, ই-মেইল : jahangirhossain8431@gmail.com