রাজধানী ঢাকা এখন মশার দখলে

0
1711

রাজধানী ঢাকা এখন মশার দখলে। এ সময় মশার সংখ্যাবৃদ্ধি, উৎপাত-উপদ্রব নতুন না হলেও এবার মশার বাড়-বাড়ন্ত ও অত্যাচার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাড়িঘর, অফিস-আদালত, রাস্তা-ঘাট সর্বত্রই মশা আর মশা। রাতে তো বটেই, দিনেও মশার কামড় থেকে নিস্তার পাচ্ছে না মানুষ। রাতে ঘরে মশারি টাঙিয়ে, স্প্রে করে কিংবা কয়েল জ্বালিয়ে মশা নিবারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পত্রিকায় একটি ছাপা হয়েছে, যাতে দেখা গেছে, বড় মশারির মধ্যে একটি ছোট মশারি টাঙ্গানো হয়েছে। শিশুকে মশার কামড় থেকে সুরক্ষার জন্যই এই ব্যবস্থা। গত ২৩ ফেব্রæয়ারি মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের একটি বিমানের যাত্রা ১৫ মিনিট বিলম্বিত হয় মশার কারণে।

বিমানটি ছাড়ার আগে দেখা যায়, ভেতরে কিছু মশা দিব্যি ওড়াউড়ি করছে। অত:পর মশা মুক্ত করেই তবে বিমানটি ছাড়া হয়। এই দু’টি নজির থেকেই উপলব্ধি করা যায়, মশার উৎপাত-উপদ্রব কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং জনজীবন কতটা অসহনীয় বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে। মশার এই সর্বব্যাপী বিস্তার ও আগ্রাসনের জন্য রাজধানীবাসী দুই সিটি কর্পোরেশনকেই দায়ী করছে। সিটি কর্পোরেশনদ্বয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করার। গত বছর প্রজজন মওসুমের শুরুতে স্বাস্থ্য বিভাগ মশা নিধনের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা না করায় মশার সংখ্যা ও উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কর্তৃপক্ষীয় তরফে দাবি করা হয়েছে, এবার শুরুতেই মশা নিধন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। যথাসময়ে যথাযথভাবে কার্যক্রম শুরু করা হলে পরিস্থিতি এতটা নাজুক হওয়ার কথা নয়। ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশা দমনের কার্যক্রম ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম নগরবাসীর কাছে দৃশ্যামান নয়। ঝাঝালো ধুঁয়া দিয়ে মশা সাময়িকভাবে সরিয়ে দেয়া হয়তো সম্ভব হতে পারে, নিধন কতটা হয় তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, ওষুধের গুনমান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। এ ধরনের লোক দেখানো কার্যক্রমের মধ্যমে রাজধানীকে মশামুক্ত করা অসম্ভব। এবার মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি কপোরেশনের তরফে বরাদ্দ রয়েছে ৪৫ কোটি টাকারও ওপর। গত বছরের তুলনায় এ বরাদ্দ বেশি। তারপরও মশা নিয়ন্ত্রণ ও নিধনে সাফল্য নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের ব্যর্থতা শিকার করে বলেছেন, এত কিছু করেও মশাকে বাগে আনা যাচ্ছে না। যতদূর জানা যায়, যে বরাদ্দ প্রতিবছর থাকে, তার সিংহভাগই চলে যায় ওষুধ কেনার জন্য। এই ওষুধ কেনা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। নিম্নমানের ওষুধ কেনা হয়, প্রয়োজনের তুলনায় কম কেনা হয়, এ জাতীয় অভিযোগ পুরানো। অকার্যকর ও সঠিক পরিমাপের চেয়ে কম ওষুধ ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিধন সম্ভব নয়। অভিযোগ আছে, এখাতের একটা বড় অংকের অর্থ বেহাত বা লুটপাট হয়ে যায়। এছাড়া, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে লোকবল ও সাজ-সরঞ্জামের অভাব রয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশনেরই। বলার অপেক্ষা রাখেনা, এক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও চিন্তা-ভাবনার অভাব যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাবও। কোথাও কোথাও ওষুধ ছিটিয়ে কিংবা ফগার মেশিন চালিয়ে মশা দমন আদৌ সম্ভব নয়। মশা দমন ও নিধন করতে হলে মশার প্রজজনক্ষেত্রের দিকে সর্বাগ্রে দৃষ্টি দিতে হবে। গোটা শহর কার্যত ময়লা-আবর্জনায় ভাগাড় হয়ে আছে। রয়েছে মাইলের পর মাইল খোলা নর্দমা। দ্ইু সিটি কপোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা ময়লা ফেলার জায়গা রয়েছে। এসব জায়গায় ফেলা ময়লা ঠিকমত পরিষ্কার করা হয় না। ময়লা ফেলার স্থানগুলো মশা প্রজজনের একেকটা ‘উৎকৃষ্ট’ ক্ষেত্র। খোলা নর্দমাগুলোও যথাসময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। মশার বংশ বিস্তারে নর্দমাগুলোর বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে। শুধু তাই নয়, দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রায় তিন হাজার বিঘা জলাশয় রয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি জলাশয়ই ময়লা-আবর্জনার স্তুুপে পূর্ণ। এগুলোও মশার উৎস হিসাবে কাজ করছে। মশার প্রজজনস্থলসমূহ অবারিত ও উন্মুক্ত রেখে মশা দমন ও নিধনে সফল হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না। প্রজজন ও উৎসস্থলেই মশার বংশ ধ্বংস করতে হবে। আবর্জনা দ্রæত অপসারণ করতে হবে। আবর্জনা ফেলার জায়গাগুলো সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে  এবং নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ওই সব জায়গায় মশার জন্ম হতে না পারে। খোলা নর্দমাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে, ওষুধ দিতে হবে যাতে সেখানে মশা জন্মাতে না পারে। একইভাবে জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে মশার লার্ভা মুক্ত করতে হবে। উৎসে মশা দমন ও নিধন না করে উড়ন্ত মশা দমন ও নিধন কার্যক্রম চালিয়ে ঢাকাকে মশামুক্ত করা যাবে না। সিটি কর্পোরেশনদ্বয়কে এই সত্য উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ওয়ার্ড কমিশনারদের আরও দায়িত্বশীল ও সক্রিয় হতে হবে। আমরা মনে করি, সিটি কর্পোরেশনদ্বয়ের পক্ষে এ কাজ করা খুব সহজসাধ্য হবে না যদি না নগরবাসীর কাছ থেকে যথাযথ সহায়তা আসে। নগরবাসীর উচিৎ, নগর বসবাসযোগ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত রাখার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা ও নাগরিক দায়িত্ববোধই পারে এই নগরকে মশা মুক্ত রাখতে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one + fourteen =