ব্যর্থ সিটি কর্পোরেশন মশা নিধনে

0
1057

নগরবাসীর মনে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু আতঙ্ক, শিশু ও শিক্ষার্থীদের অবস্থা নাজুক// মশার যন্ত্রণায় অস্থির নগরবাসী। অভিজাত এলাকা মিন্টু রোডের মন্ত্রিপাড়া, সচিবালয়, বেইলি রোড, ধানমন্ডি, উত্তরা, গুলশান, বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ। ঋতু পরিবর্তনের এই সময় দিনের বেলায় গরম সেই সাথে মশার উৎপাত। দিনের বেলায়ও এখন মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। আর রাতের বেলায় মশার যন্ত্রণা সে তো অসহ্য। বলতে গেলে মশার যন্ত্রণায় নগরবাসীর ত্রাহি অবস্থা। মশা নিয়ন্ত্রণে উত্তর দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনই ব্যর্থ। সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল অনেক ব্যর্থতা ঢাকতে রাজউকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। মশার উপদ্রবের সাথে নগরবাসীকে এখন মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের আতঙ্ক তাড়া করছে। বিশেষ করে চিকন গুনিয়া, ডেঙ্গু এসব রোগের আতঙ্ক নগরবাসীর মনে। তবে বিশেষজ্ঞরা নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হতে পরামর্শ দিয়েছেন।

 

মশার উপদ্রবে বিশেষ করে শিশু এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থা একেবারেই নাজুক। আগামি ২ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। মশার উপদ্রবে পরীক্ষার্থীরা দিনে বা রাতে ঠিক মতো পড়তে পারছেন না। গুলশান এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাফিসা বলেন, মশার যন্ত্রণায় দিনের বেলায়ও পড়ার টেবিলে বসতে পারি না। স্প্রে করে বা কয়েল জ্বালিয়ে পড়তে বসলে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাই বাধ্য হয়ে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে খাটে শুয়ে বসে পড়তে হয়। তবে খাটে পড়লে তো টেবিলে বসে পড়ার মতো মনযোগ আসে না। খাটে শুয়ে পড়তে পড়তে অনেক সময় ঘুম চলে আসে।

রাজধানীর মগবাজার, ইস্কাটন, ইস্কাটন গার্ডেন, রমনা ও মিন্টু রোডের বিভিন্ন এলাকায় দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, মন্ত্রী, সচিব, সিনিয়র সচিব ও উপ-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরকারি বাসভবন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদর দফতর ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ও এ এলাকায়। এই ভিআইপি এলাকার বাসিন্দাদেরও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না মশা। গত ১৫/২০ দিনের মশার উপদ্রবে ওই এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই অসহনীয় মশার উপদ্রব। মশার উপদ্রব এতোটাই বেড়েছে যে সম্প্রতি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজে মশা ঢুকে পড়ায় বিমানটি ছাড়তে দুই ঘণ্টা দেরি হয়। বিমানবন্দরে মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ এলাকার মশা উপদ্রব এখনো কমেনি।

দুই সিটি কর্পোরেশনের চলতি অর্থ বছরের জন্য মশা নিধনের বাজেট ৩৭ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়েও মশা নির্মূল হচ্ছে না। বরং দিন দিন মশার যন্ত্রণা বাড়ছেই। ঢাকার বাসিন্দারা যেনো মশার কাছে অসহায়। রাতে তো বটেই দিনের বেলায়ও চলছে মশার অত্যাচার। মশারি টানিয়ে, কয়েল জ্বালিয়ে, ইলেকট্রিক ব্যাট কিংবা মশানাশক ওষুধ স্প্রে করেও রক্ষা পাচ্ছে না। অথচ মশা নিধনে বছর বছর বরাদ্দ বাড়াচ্ছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশার উপদ্রবও।

দুই সিটি কর্পোরেশনই মশা নিধনে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে নগরবাসীর পক্ষ থেকে। কিছু প্রকল্প হাতে নিলেও মাঠপর্যায়ে ঠিকমতো তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অনেকেই এসব উদ্যোগকে লোক দেখানো বলে মন্তব্য করছেন। মশার উপদ্রব বন্ধ করতে না পারলেও দুই সিটি কর্পোরেশন এর ব্যর্থতার দায়ভার নিতেও নারাজ। তারা বলছে, মশা নিয়ন্ত্রণে তারা বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নগরবাসী এর সুফল পাবেন। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন পুরানো ঢাকায় কোন মশঅ নেই বলে দাবী করেছেন। তিনি বলেছেন, পুরানো ঢাকায় মশা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুরানো ঢাকায় বেড়াতে গেলে মশারি ছাড়াই রাতে আরামে ঘুমানো যাবে বলেও মেয়র বলেন।

তবে মেয়রের এই দাবীর সাথে বাস্তবে অনেক এলাকার চিত্র একেবারে ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা মশা নিয়ন্ত্রণে না আসার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে তারা দেখছেন সিটি কর্পোরেশনের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা অর্থাৎ মশা নিধনের নামে লোক দেখানো বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা। এছাড়া রাজধানীর জলাশয়গুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা এবং সেখানে সিটি কর্পোরেশন ঘোষিত কোনো ধরনের অভিযান না চালানোয় মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাশাপাশি শীতকালের কয়েক মাসে মশা নিধন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে বলেও তারা মনে করেন। সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনেও মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। রাত নামলে তা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। মশার উপদ্রবের সাথে নগরবাসীকে এখন মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের আতঙ্ক প্রতিনিয়ত তাড়া করছে। পরীবাগ এলাকার বাসিন্দা মাসুমা আক্তার বলেন, গত বছর চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। এ বছরও মশার উৎপাত অনেক বেশি। এবার যদি আবার মশাবাহিত রোগ হয় তাহলে বাঁচার উপায় থাকবে না।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক আবদুস সোবাহান বলেন, মশার উৎপত্তিস্থলে অভিযান না চালিয়ে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন বিভিন্ন ধরনের লোক দেখানো কর্মসূচি নিয়ে। এসব করে মশা নিধন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আর একটু গরম বাড়লে এবং এরপর বৃষ্টি পড়লে মশার উপদ্রব আরও বাড়বে। অথচ এখনো মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন ডোবা, জলাশয়ে মশা মারার অভিযান এখনো তেমন ভাবে শুরু হচ্ছে না। শুধু লোক দেখানোর জন্য সড়কের আশপাশে মশা মারার অভিযান চালাচ্ছে।

রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআরবি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নুজহাত নাসরিন বলেন, আগে জলাশয়গুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করতে হবে। কারণ মশার বংশবৃদ্ধি হয় সেখান থেকে। যেহেতু তারা দাবি করছে- মশা নির্মূলে তারা সব করছেন, সেহেতু তাদের উচিত নিজেদের দুর্বলতার জায়গা খুঁজে দেখা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মশা নিধনে দুই সিটি কর্পোরেশন একই ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বর্তমানে মশা নিধনের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রামকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে লার্বিসাইড ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। মশা নির্মূলে স¤প্রতি দুই সিটি কর্পোরেশন তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কার্যক্রম উদ্বোধন করছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও উত্তর সিটি কপোরেশনের প্যানেল মেয়র ওসমান গণির সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীবাসীকে যতদ্রæত সম্ভব মশার উপদ্রব থেকে মুক্ত করার সর্বপ্রকার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তারা দু’জনেই আশাবাদী মশার উৎপাত দ্রæতই নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, শহরের প্রায় অর্ধেকের বেশি স্থানে মশার ওষুধ ছিটানো সম্ভব হয় না। মশা নিধনে দুর্বলতার বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, অধিকাংশ জলাশয় রাজউকের। এরপর সরকারি অনেক স্থানে সিটি কর্পোরেশন যেতে পারে না। এছাড়া বাসা-বাড়ির ভেতরে মশার ওষুধ ছেটানো সম্ভব হয় না। একই সমস্যার কথা জানিয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির হোসেন বলেন, অনেক এলাকায় আমরা মশার ওষুধ ছিটাতে পারি না। এছাড়া ওয়াসার খালে পানি প্রবাহ না থাকায় মশার বংশ বিস্তার সেখানে হয়। তবে নতুন করে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। আশা করি, সমাধান আসবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগে গত ১১ থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৯৩টি ওয়ার্ডের ১০০টি সাইটে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াবাহী এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র বিষয়ে জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপকারীরা ১০০টি প্রতি ওয়ার্ড, সাইটের ২০টি করে হোল্ডিংয়ে (দেয়ালের ভেতরে ও ঘরের চারপাশে) মোট দুই হাজার হোল্ডিংয়ে জরিপ চালায়। জরিপে দেখা গেছে, মশার দাপট ঢাকা দক্ষিণের তুলনায় উত্তরে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা জানান, ব্রæটো ইনডেক্সের মাধ্যমে মশার প্রকোপ নির্ধারণ করা হয়। জরিপকারীরা বাসাবাড়িতে পরিত্যক্ত অবস্থায় কৌটা, খালি টিন, টায়ার পড়ে আছে কি-না তা দেখার পাশাপাশি মশার লার্ভা সংগ্রহ করেন। ব্রæটো ইনডেক্স ২০ হলো স্বাভাবিক মাত্রা। তিনি জানান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১১টি এলাকা-বনানী, বসুন্ধরা, গাবতলী, মগবাজার, মালিবাগ (একাংশ), মিরপুর, মহাখালী, নাখালপাড়া, পূর্ব শ্যাওড়াপাড়া, টোলারবাগ ও উত্তরা-৯ নম্বর সেক্টর এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৮টি এলাকা- মিন্টুরোড-বেইলি রোড, শান্তিনগর, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, কলাবাগান, গুলবাগ, বাংলাবাজার ও মেরাদিয়ায় মশার ব্রæটো ইনডেক্সের স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, মশার প্রকোপ মারাত্মকভাবে বাড়ায় ১ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা জরিপ চালানো হয়। কোনো কোনো এলাকায় এ জরিপ পরিচালিত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, গত জানুয়ারিতে পরিচালিত জরিপে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের যে ১৯টি এলাকা অধিক মশকপ্রবণ চিহ্নিত হয়েছিল, সেসব এলাকাতে ফের জরিপ চালানো হয়। জানুয়ারিতে শুধুমাত্র এডিসবাহী মশার নমুনা সংগ্রহ করা হলেও এ মাসের জরিপে তিন ধরনের মশার নমুনা-এডিস (ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকাবাহী), কিউলেক্স (ফাইলেরিয়াবাহী) ও এনোফিলিসের (ম্যালেরিয়াবাহী) ওপর জরিপ পরিচালিত হয়। এ জরিপ প্রতিবেদন ২/১ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 + one =