নকলের ভিড়ে আসল পণ্য হারিয়ে যেতে বসেছে

0
939

নকল পণ্যের দৌরাত্ম্যে আসল পণ্য চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। বলা যায়, নকলের ভিড়ে আসল পণ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে, ইলেকট্রনিক্স ও কসমেটিক্স সামগ্রী এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধও দেদারছে নকল হচ্ছে। পাড়া-মহল্লার ছোট দোকান থেকে শুরু করে অভিজাত চেইন শপে এসব নকল পণ্য অবাধে বিক্রি হচ্ছে। নকল পণ্য এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যে, দেখে বোঝার উপায় নেই, এটি আসল, নাকি নকল। নকল পণ্যের এ মহোৎসব দেখে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নকল পণ্যের যে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়, তাতে এটাই মনে হচ্ছে, আমরা যেন নকল পণ্যের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি।

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিশুদের গুঁড়া দুধ, চকলেট, তেল, ঘি, আটা, মসলা, মধু, সাবান, দই, মিষ্টি, বোতলজাত পানি, মোবইল ফোন, টিভি, ফ্রিজ, এনার্জি বাল্ব, খেলনা গাড়ি, কম্পিউটার থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই যা নকল হচ্ছে না। এ নিয়ে বিএসটিআই বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ ও উদ্বেগ কোনোটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মাঝে মাঝে দায়সারা গোছের অভিযান চালিয়ে কিছু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়ার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এতে নকল পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন তো বন্ধ হচ্ছেই না, উল্টো পুর্নদ্যোমে উৎপাদন বহাল রয়েছে। এর কারণ নকল পণ্যের জন্য যে জরিমানা দিতে হয়, তা উৎপাদন ও বিক্রি করে তার চেয়ে শত গুণ বেশি লাভ হয়। ফলে নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের ওপর তার তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না।

আসল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে নকল পণ্য মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। আসল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে উন্নত মানের কাঁচা মাল সংগ্রহ এবং তার যথাযথ মান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করতে হয়। এ প্রেক্ষিতে তাদের উৎপাদিত পণ্যই যদি হুবহু নকল করে বাজারে ছাড়া হয়, তবে আসল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক ক্ষতি ও হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। উন্নত বিশ্বে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও নকল পণ্যের কথা চিন্তা করা যায় না। সেসব দেশে খাদ্য বা অন্য কোনো পণ্যে ভেজাল বা নকল বলে ধরা পড়লে বিক্রেতাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। এমনকি কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদ্ডেরও বিধান রয়েছে। আমাদের দেশে নকল পণ্যের ক্ষেত্রে আইনের ব্যাপক দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতার কারণে নকলকারীরা বছরের পর বছর ধরে প্রশ্রয় পেয়ে আসছে। কেউ কেউ ধরা পড়লে জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। মাঝে মাঝে র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালিয়ে নকল পণ্য জব্দ এবং জরিমানা করে দায় সারতে দেখা যায়। নকল পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনকারী ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নকল ও ভেজাল পণ্যের কারণে জনস্বাস্থ্য যে মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এর সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম কোমলমতি শিশুরা। নকল ও ভেজালকৃত দুধ, প্যাকেটজাত জুস, চিপস, চকলেট, বিস্কুটের মতো শিশু খাদ্য তাদের বিকাশ ও স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে চলেছে। প্রসাধন সামগ্রী নকলের বিষয়টি বছরের পর বছর ধরেই চলছে। দেশি-বিদেশি নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত সৌন্দর্যবর্ধক তেল, সাবান, শ্যাম্পু, ক্রীম, ফেস পাউডার, পারফিউম, লোশনসহ অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী বেশুমার নকল হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত শপিং মলে এসব প্রসাধন সামগ্রী নির্বাধে বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা আসল-নকল পণ্যের পার্থক্য বুঝতে না পেরে তা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রসাধন সামগ্রীর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ব্যবহারকারীরা ত্বকের মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহারের ফলে ত্বক পুড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে রোগ উপশমকারী ওষুধের নকল ও ভেজালের বিষয়টি সর্বত্র বিরাজমান। বড় বড় নামকরা হাসপাতাল থেকে নকল এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ ও জরিমানা করতে মাঝে মাঝে দেখা যায়। নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারি অনেকগুলো কোম্পানিকে কয়েক বছর আগে নিষিদ্ধ ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপরও নকল এবং ভেজাল ওষুধের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীতে নকল ও ভেজালের হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এমনিতে মাছ-গোশত, শাক-সবজি ও ফল-মূলে বিষাক্ত কেমিক্যালের উপস্থিতি বরাবরই রয়েছে, তার উপর চাল, আটা, ময়দা, মসলা, তেল, ঘি, মিষ্টি, দইসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর নকল এবং ভেজাল ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই নকল ও ভেজালের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার যেন কোনো উপায় নেই। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ কীভাবে সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকবে? নকল ও ভেজালকারীদের কাছে মানুষ জিম্মি হয়ে আছে। এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ কি করছে? তারা কি নকল ও ভেজালকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে?

বেশ কয়েক বছর আগে ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ দৌলা স্বপ্রণোদিত হয়ে ভ্রাম্যমান আদালত নিয়ে নকল ও ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অভিযান চালিয়েছিলেন। অনেক নকল ও ভেজালকারীকে ধরে তাৎক্ষণিক শাস্তি ও জরিমানা করেছিলেন। এতে কিছুটা হলেও নকল ও ভেজালকারীরা ত্রস্ত হয়েছিল। তার এই অভিযান তখন সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। এই অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, সেই পুরনো চিত্র ফিরে আসে। এখন নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন এবং বিপণন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি যদি রোধ করা না যায়, তবে নকল পণ্য আসল পণ্যকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলবে। এতে আসল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িকভাবে মার খেয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়বে, যা সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। তাই হুমকিতে থাকা জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতির ক্ষতি ঠেকাতে নকল ও ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর বিকল্প নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু দোকান ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার মতো দায়সারা শাস্তি দিলে চলবে না। যেসব চিহ্নিত এলাকায় নকল পণ্য উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসব এলাকায় অভিযান চালিয়ে সেগুলোকে ধ্বংস করতে হবে। এর সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। যেহেতু বিদ্যমান আইনে নকল ও ভেজালকারীদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই আইন সংশোধন করে কঠোর আইন করতে হবে। নকল ও ভেজাল বিরোধী অভিযান শুধু রাজধানীতে করলে চলবে না, দেশব্যাপী অভিযান চালাতে হবে। পাশাপাশি ক্রেতা ও ভোক্তাদের নকল এবং ভেজাল পণ্যের ব্যাপারে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচারণামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 − thirteen =