ঢাকা ডিসি অফিসের সার্ভেয়ার আজাদ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ

0
1264

স্টাফ রিপোর্টারঃ
ঢাকা জেলা প্রশাসনের আওতাধীন এলএ (ভূমি অধিগ্রহণ) শাখার সার্ভেয়ার আজাদ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভূমি অধিগ্রহনকালীন সময়ে জমির প্রকৃত মালিককে তার জমির কাগজপত্রে বিভিন্ন ত্রুটি দেখিয়ে আটকে রেখে নির্দিষ্ট পরিমান টাকায় চুক্তি করে চেক হস্তান্তরের সমস্ত কিছু প্রসেসিং করে দেন আজাদ সিন্ডিকেট। শতকরা ৪০ ভাগ কমিশন না দিয়ে কোন জমির মালিকই তার জমিমুল্যের চেকের জন্য ক্লিয়ারিং ছাড়পত্র পায় না আজাদ সিন্ডিকেটের টেবিল থেকে। আবার চেক পাইলেও জমি মুল্যের অর্ধেক টাকা পাইতে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয় ঐ সব জমি মারিকদের। দিনের পর দিন ডিসি অফিসের বাড়ান্দায় ঘুরাঘুরি করতে হয় জমি মালিকদের। মোদ্দা কথা সার্ভেয়ার আদাজ সিন্ডিকেটের সাথে কমিশন চুক্তিতে না গেলে সরকারের নিকট থেকে কোন জমির মালিকই তার ন্যায্য পাওয়ানা উত্তোলন করতে পারেনা। আবার কমিশনে চুক্তি করলে জমিমুল্যের তিনগুন টাকার চেকও পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে। আজাদ সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য আনিসুল ইসলাম ও ফরিদ উদ্দিন।

 

আনিস ও ফরিদ অবৈধভাবে আদায় করা টাকা ডিসি অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে একদম উপর মহলের কর্মকর্তা পর্যন্ত ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়। অপরাধ বিচিত্রার ঈগল টিমের অনুসন্ধানে আজাদ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনিয়মের বিভিন্ন দিকের সেই চিত্রই উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিসি অফিসের এলএ শাখাটি দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, জালিয়াত এবং অসাধুদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। নির্দিষ্ট হারে ঘুষ প্রদান করে একজনের ক্ষতিপূরণ আরেক জনকে দিয়ে দেয়া হয়। চাহিদামত ঘুষ না দিলে প্রকৃত ভূমি মালিকরা তাদের ক্ষতিপূরনের চেক পায় না। এমন কি সরকারি জমির ক্ষতিপূরনের টাকা সাধারণ পাবলিক উত্তোলন করে নেয়। বর্তমান ডিসি যোগদানের পর তিনি এলএ শাখার সংস্কারের কাজে হাত দেন। ঘুষখোর দুর্নীতিবাজদেরকে উক্ত শাখা থেকে বদলী করে দেন। ফলে এখানকার ইমেজ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিন্তু ডিসি অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, সম্প্রতি সার্ভেয়ার আজাদের শক্তিশালী একটি জালিয়াতচক্র তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে কৌশলে উক্ত শাখার কয়েক জন কর্মকর্তা ও অন্য সার্ভেয়ারকে হাত করে নেয়। একই সঙ্গে কর্মঠ এবং অভিজ্ঞ কর্মচারি এবং সার্ভেয়ারদের এখান থেকে বদলি করেত সক্ষম হন। এসব তৎপরতার কথা ডিসি স্যার জানেন না। অনেক ক্ষেত্রে তাকে ভুল তথ্য দিয়ে নিরীহ কর্মচারীদের বদলি করাচ্ছে সেই দালাল চক্রটি। যার কারনে এলএ শাখাটি আবার ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে গেছে। অনুসন্ধান আরো জানা গেছে, পূর্বাচল ৩শ ফুট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ কয়েকটি বড় প্রকল্পের ভূয়া জমির মালিকদের কয়েকটি চক্র এলএ শাখার ফান্ড থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা জাল দলিলপত্র, পর্চা, নামজারী জমা দিয়ে টাকা দাবি করতে থাকে। কিন্তু এলএ শাখায় কয়েক জন কর্মচারি ও কর্মকর্তার দৃঢ়তার জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা বর্তমানে সার্ভেয়ার আজাদের নেতৃত্বে একজোট হয়ে এসব কর্মচারি ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করছে।
উল্লেখিত সার্ভেয়ার এবং দালালচক্র পূর্বাচল ৩শ ফুট রাস্তার অধিগ্রহণকৃত ১ একর ৬৫ শতাংশ জমির ভূয়া মালিক জীবন বক্সের নামে ক্ষতিপূরনের ১৩৪ কোটি টাকা ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এসব জমি জীবন বক্সের ওয়ারিশরা অনেক আগেই একটি আবাসন কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। উক্ত সম্পত্তি কিনে আবাসন কোম্পানী নামজারি ও খাজানা পরিশোধসহ নিজেদের দখলীস্বত্ব বজায় রেখেছে। সরকারের এ ১৩৪ কোটি টাকা ভূয়া মালিকের কাছে হস্তান্তর করেত বাধা দেওয়ায় এলএ শাখায় সার্ভেয়ার কবির হোসেন তাদের রোষানলে পড়ে অন্যত্র বদলি হয়েছেন। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বেনামী উড়ো চিঠি দিয়ে এবং আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে তা বিভিন্ন জায়গায় বিলি করছেন।
এলএ শাখা সূত্র জানায়, উক্ত চক্রের নেতৃত্ব দানকারী সার্ভেয়ার আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে দুদকে (দুনীর্তি দমন কমিশন) তিনটি মামলা রয়েছে। ঢাকা কোতয়ালী থানায় দায়ের কৃত মামলা নম্বর হলো ২৭ (৮), ২৭ (৮) ও ২৯ (৮) ১৬। মামলাগুলোর চার্জশীট দেওয়া হয়েছে। কেরানীগঞ্জের একটি এলএ কেসে ভূয়া ভূমি মালিককে ৮৪ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরনের টাকা দেওয়া হয়েছে তার কোন অস্তিত্ব নেই। যে নাম ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা সম্পূর্ণ ভূয়া। দুদকের মামলায় আদালত তাকে চার্জশীট দেওয়ার আগ পর্যন্ত জামিন দেয়।
তার নামে চার্জশীট হওয়ার পরও বিনা জামিনে তিনি কিভাবে চাকরি করছেন সেটা বর্তমানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সবার মুখে মুখে ফিরছে। দুদকের চার্জশীটকৃত আসামী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিভাবে ঢাকা জেলা প্রশাসনের এলএ শাখার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে সার্ভেয়ার হিসাবে চাকুরি করছেন সেটা নিয়ে নানা মহল প্রশ্ন উঠলেও জেলা প্রশাসন এভাবে কোন পদক্ষেপই নিচ্ছেন না। ফলে আজাদ বর্তমানে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। অফিসে তার টেবিলের সামনে নানা দালাল, টাউট-বাটপার নিয়ে তিনি আড্ডা দেন। এমন কি এলএ শাখার নিচে এদেরকে সংঘবদ্ধভাবে বসে থাকতে দেখা যায়। এরা এলএ শাখাটি জিম্মি করে সাধারন মানুষকে জিম্মি করে মোট অংকের ঘুষ আদায় করছেন বলে একাধিক ভূক্তভোগী জানান। সার্ভেয়ার আনিসুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ঘুষপ্রীতির নির্দেষ্ট অভিযোগ থাকার পরও তাকে ভিপি শাখা থেকে বদলি করে এলএ শাখায় আনা হয়েছে। প্রায় দু’বছর আগে তিনি ভিপি শাখার সার্ভেয়ার ছিলেন। তখন তিনি পুরানো ঢাকায় ভিপি (অর্পিত সম্পত্তি) তালিকাভূক্ত চারটি হিন্দু বাড়ির নথি গায়েব করে ফেলেন। যাহার ভিপি কেস নং-২৩৪ ২৩৫ নবাবপুর রোড, ৫০, নভেন্দ্র চন্দ্র বাসক লেন ও ১২/১, বংশাল রোড। এ জন্য কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়। উক্ত নথি গায়েব হওয়ায় আদালতে সরকার পক্ষ মামলায় হেরে যান। ফলে সরকারের প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়। বিষয়টি জেলা প্রশাসনের প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারির জানা থাকলেও পুরস্কার স্বরূপ তাকে এলএ শাখায় বদলী করা হয়েছে। এ তিনজন সার্ভেয়ার একই এলাকার বাসিন্দা। তারা সংঘবদ্ধভাবে এলএ শাখাটি নিজেদের কারায়াক্ত করার জন্য একটি দালালগোষ্ঠী তৈরি করেছেন বলে জানা যায়। সে গোষ্ঠীর প্রধান হলো জসিমউদ্দিন নামে এক উমেদার। সে কোতয়ালী এসি ল্যান্ড অফিসে দীর্ঘদিন ধরে উমেদারী এবং নামজারির দালালী করছেন। এর আগে তিনি কোর্টপাড়ায় ফেরি করে চা বিক্রি করতেন। বর্তমানে নামজারির উমেদারী ছাড়াও তিনি এলএ শাখায় দালালী করছেন। তিনি তার এলাকা কুমিল্লার লাকসাম থেকে প্রায় ৫০/৬০ জন ব্যক্তিকে ঢাকায় এনে দালালী কাজে নিয়োজিত করেছেন। যারা তার পক্ষে কাজ করছেন। অভিযুক্ত সার্ভেয়াররা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, একটি বিরোধী চক্র তাদের মান-সম্মান নষ্ট করার জন্য এসব মিথ্যা অভিযোগ করছেন। দুদকের মামলার বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারে রয়েছে। আদালতের নির্দেশেই সব কিছু হচ্ছে।
জসিম উদ্দিনের নেতেৃত্বে আরেকটি প্রতারক চক্র ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যায়ল কেন্দ্রীক নানা জালিয়াতি, দলীল, প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা এতই চতুর এবং সংঘবদ্ধ যে দীর্ঘদিন ধরে এসব অপকর্ম চালালেও ডিসি অফিস থেকে পর্যন্ত ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। দালাল ও জালিয়াতচক্রের সদস্যদের অন্যতম হলো-শাহ আলম, আব্দুল হান্নান, সিএস আক্কাস, আবদুল মতিন ও মজিবুর। এর মধ্যে সিএস আক্কাস দলিল পর্চা জালিয়াতিতে বেশ দক্ষ। বিশেষ করে বৃটিশ আমলের সিএস পর্চা জালিয়াতিতে বেশ দক্ষ। বিশেষ করে বৃটিশ আমলের সিএস পর্চা জালিয়াতির ক্ষেত্রে তার সমকক্ষ কেউ নেই। যার কারনে তাকে সিএস আক্কাস বলা হয়। বরং ডিসি অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মচারিদের সহযোগিতায় তারা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা।
জসিম উদ্দিনকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে মতামত নেওয়ার জন্য একাধিক বার মোবাইল ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমন কি এসএমএস করা হলেও তার কোন প্রতি উত্তর দেননি।
নাসের আহমেদ নামে একজন ভূক্তভোগীর থেকে জানা যায় দালাল জসিম বর্তমানে ঢাকা শহরে একাধিক অফিস মেইনটেন্ট করছেন। তার একটি অফিস রয়েছে ২৬ হাটখোলা রোডের দেলোয়ার কমপ্লেক্সে। অপর একটি অফিস রয়েছে ওয়ারীর ৮/১, হেয়ার ষ্ট্রীটে। তার নামে একটি অখ্যাত পত্রিকার ডিক্লারেশন রয়েছে। যা বাজারে পাওয়া না গেলেও স্বার্থসিদ্ধর জন্য বিভিন্ন মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন। তার অন্যায় আবদার না শুনলেই তিনি সে পত্রিকায় মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে তা ফটো কপি করে বিভিন্ন দপ্তরে পাঠায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোটপাড়ার একজন দালাল কিভাবে পত্রিকার ছাড়পত্র পেলো?
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তানভীর আহমেদ বলেন, এলএ শাখা ঘিরে বেশ কিছু দালাল ও টাউটচক্র সক্রিয় রয়েছে সেটা আমার নলেজে রয়েছে। মাঝে মাঝে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগও পাই। আমি এদের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযান চালাবো। আমার দপ্তরের কেউ জড়িত থাকলেও তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেবো। এর মধ্যে সাধারণ মানুষদেরকেও আরো সচেতন হতে হবে। তারা এলএ শাখায় পকেটে ঘুষ নিয়ে ঘুরে। অথচ আমরা বলছি, ক্ষতিপূরনের টাকা নিতে কোন ঘুষ লাগে না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 + three =