যক্ষ্মায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে চা শিল্প শ্রমিকরা

0
590

যক্ষ্মায় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে চা শিল্প শ্রমিকরা। দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখের অধিক মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগের কারণে প্রতি বছর বাংলদেশে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার লোকের মৃত্যু হয় বলে দাবি করছে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ চিকিৎসা নিয়ে কর্মরত সংস্থা হিড বাংলাদেশ। চিকিৎসকদের মতে, বস্তির তুলনায় সরকারি চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত চা শ্রমিকদের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বন্দি থেকে ঘনবসতি ও নোংরা পরিবেশে বসবাস, দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা এবং অসচেতনতার কারণে তুলনামূলক অধিক পরিমাণে যক্ষ্মাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, চা বাগান বেষ্টিত বাংলাদেশে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেট বিভাগ যক্ষ্মা রোগের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

চা বাগানগুলোতে যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণের হারও অনেক বেশি। গত বছরে সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে চার হাজার ৬৮৮ জন, হবিগঞ্জে চার হাজার ৭৭৬ জন এবং সিলেট জেলায় ৫২৩৯ জনসহ তিন জেলায় যক্ষ্মারোগী ১৪ হাজার ৭০৩ জন। সংশ্লিষ্টরা জানান, চা বাগানে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকে অসচেতন যারা উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। চা বাগানের নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর থেকে এখনো অনেকেই বাইরে বের হতে পারছে না। ঘনবসতি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস, মাদকাসক্ত, পরিমিত খাবারের সমস্যা সবমিলিয়ে বস্তির তুলনায় চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে যক্ষ্মা রোগের প্রবণতা অনেক বেশি। চ্যালেঞ্জ টিবি বাংলাদেশ (সিটিবি) প্রজেক্ট সূত্র জানায়, বিশ্বের যে ২২টি দেশের মধ্যে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক তার মধ্যে বাংলাদেশ ৬ষ্ঠ। প্রতি বছর দেশে প্রায় তিন লাখ ২১ হাজার মানুষ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন এবং এর মধ্যে প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মতে, সারা দেশে প্রতি লাখে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ২২৫ জন রোগী পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র সিলেটে এই হার ৩০০ বেশি। চ্যালেঞ্জ টিবি বাংলাদেশ (সিটিবি) প্রজেক্টের মৌলভীবাজার জেলা প্রকল্প কর্মকর্তা তাপস বাড়ৈ বলেন, গত বছর এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাসে সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের ১৬টি উপজেলায় ৫৯৪ জন যক্ষ্মা রোগী পাওয়া যায়। এই সময়ে ৪১টি চা বাগান, সাতটি পুঞ্জি এবং ১৩টি রাবার বাগানের ৩৫ হাজার ১৩৭টি পরিবারের এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৩ জন রোগী চ্যালেঞ্জ টিবি কার্যক্রমের মাধ্যমে উপকার পেয়েছেন। তিনি আরো বলেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে চা বাগানের কম্পাউন্ডার, ড্রেসার, মা, ম্যানেজমেন্ট, গ্রাম্য চিকিৎসকদের নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। হিড বাংলাদেশের যক্ষ্মা, কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের কুষ্ঠ প্রকল্প ইনচার্জ পরেশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, বাড়ি ঘরের অবস্থা ও অসচেতনতা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের অভাব, নোংরা পরিবেশ ও কলোনিতে ঘনবসতি বেশি থাকায় চা বাগানগুলোতে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগের প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক বেশি। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চা বাগানগুলো এসব রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে এবং সরকারি হাসপাতালে এসে রোগীরা চিকিৎসা গ্রহণ করছে। হিড বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, গত এক বছরে এই উপজেলায় চার হাজার ৯৫৩ জন রোগীর কফ পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে যক্ষ্মার জীবাণুযুক্ত রোগীর সংখ্যা ৩৮৬ জন, জীবাণুমুক্ত ২৩০ জন, অন্যান্য ৯৫ জন, পূর্ণ আক্রান্ত ৪০ জন, ফেইলিউর পাঁচজন ও এমআরডি আক্রান্ত ছয়জন রোগী পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ৩০ জন। হিড বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল উপজেলার টিবি সেন্টারের অ্যাসিসটেন্ট পঞ্চম কৈরী বলেন, শ্রীমঙ্গলে বছর বছর যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের মধ্যে এ উপজেলায় ১০০৭ জনের কফ পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৮৫ জনের মধ্যে যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া গেছে। ক্রমেই তা বৃদ্ধি পেয়ে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১২৭৪ জনের মধ্যে ৯৮ জন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩৪২ জনের মধ্যে ১০৩ জন ও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৩০ জনের মধ্যে ১০০ জন রোগীর কফে যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া গেছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় হিড বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ টিবি প্রকল্পের পরিচালক মনোরো জ্যাকব বলেন, যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যে প্রকল্পটি সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার চা বাগান, রাবার বাগান, খাসিয়া পুঞ্জিসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য (কফ ও অন্যান্য) পরীক্ষা করে আসছে। এ প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে ১০ হাজার ১৮৬ জন যক্ষ্মা রোগী আরোগ্য পেয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কর্মকর্তা ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো বলেন, যক্ষ্মা (টিউবারকিউলোসিস বা টিবি) একটি সংক্রামক রোগ। যার কারণ মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামের জীবাণু। এটি যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির কফ, হাঁচি, কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি হাসি, কথা বলার মাধ্যমেও এ জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এ জীবাণু শ্বাসের মাধ্যমে অন্য ব্যক্তির ফুসফুসে প্রবেশ করে। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক থাকলে এতে কোনো সমস্যা হয় না। এ ব্যাপারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে যক্ষ্মা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, এইচআইভিআইর পর যক্ষ্মা হচ্ছে দ্বিতীয় সংক্রামক ব্যাধি যে রোগে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। ‘যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা আছে এবং তা প্রতিরোধ করা যায়’ এ তথ্যের ওপর নির্ভর করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) তাদের নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এতে সঠিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে এই পরিকল্পনার অধীনে আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা রোগ ৯০ শতাংশ এবং যক্ষ্মা রোগের কারণে মৃত্যুর হার ৯৫ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

sixteen + 5 =