ইসলামের আবির্ভাব ঘটল, অন্ধকার টুটে গেল

0
703


সাইয়িদ সুলাইমান নদবী (রহ.) ইসলাম প্রসঙ্গ আলোচনা করে বলেনÑ যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটল, অন্ধকার টুটে গেল। মানুষ প্রথমবারের মতো তাওহিদের বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে পারল। মানবিক ভ্রাতৃত্বের অর্থ তাদের বোধগম্য হলো। এ ভ্রাতৃত্ব মানুষের মধ্যে কোনো বিভাজন রাখে না এবং কৃত্রিম মানদ-ের বিনাশ ঘটায় ইসলামি সভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো তা আসমান-জমিনের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার নির্ভেজাল ও অবিমিশ্র একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

সত্যিকার অর্থে আল্লাহ তায়ালা একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত ইলাহ। তিনি এক ও অদ্বিতীয়; তার কর্তৃত্বে কারও অংশীদারত্ব নেই। তার রাজত্ব ও সাম্রাজ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তিনিই সম্মানিত করেন, তিনি অপদস্থ করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা অপরিসীম দান করেন। যাতে জীবনের জন্য কল্যাণ ও উপযোগিতা রয়েছে তা-ই তিনি রীতিবদ্ধ করেছেন। সব মানুষ তার দাস। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ও তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার ক্ষেত্রে সবাই সমান। এতে কোনো মানবিক বা পীরের ওসিলার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করা, তার আদেশ-নিষেধ মান্য করা এবং তার নাজিলকৃত শরিয়া বাস্তবায়ন করা মানুষের ওপর আবশ্যক। একত্ববাদের উপলব্ধির উচ্চমার্গীয়তা মানুষের ভেতর ব্যক্তিত্বের মর্যাদা এবং আল্লাহর সৃষ্টির কারও কাছে নতশির না হওয়ার চেতনা জাগ্রত রাখে। ফলে তার চিন্তা ও কর্মের পরিম-ল থাকে স্বাধীন। আল্লামা সাইয়িদ সুলাইমান নদবী (রহ.) লিখেছেন, ‘আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.) একত্ববাদের যে বিশ্বাসের প্রবর্তন ঘটিয়েছেন, তা মানুষকে তার চেতনা ও বোধের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী ভয়ভীতি থেকে মুক্তি দেয়। এ বিশ্বাসের কল্যাণে মানুষ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। কারণ ইতঃপূর্বে যা কিছুর উপাসনা করা হতোÑ সূর্য, পৃথিবী, চন্দ্র, সাগর, আগুন ইত্যাদি, তার সবকিছুকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের বশীভূত করে দিয়েছেন। মানুষের কাছে মানব সম্প্রদায়ের রাজা-বাদশাহদের প্রতাপ ও ভয়ভীতি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ব্যাবিলন ও মিশরের দেবতারা, ইরান ও ভারতের দেবতারা মানুষের খেদমতগার, তাদের কল্যাণের রক্ষক এবং তাদের রাজ্যের পাহারাদার প্রমাণিত হয়। দেবতারা রাজা-বাদশাহকে তাদের পদে আসীন করে না; বরং মানুষই রাজা-বাদশাহকে উপরের আসনে বসায় এবং নিচে টেনে নামায়। যেসব মনুষ্য সমাজ এসব দেবতার কর্তৃত্বের অনুগত ছিল, সেগুলো ছিল নষ্ট, ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত সমাজ। প্রচলিত কুসংস্কার মানুষকে নানা স্তরে বিভাজিত করে রেখেছিল; মানুষের মধ্যে দুটি শ্রেণি নির্মাণ করেছিলÑ অভিজাত শ্রেণি ও নিম্নবর্গীয় শ্রেণি। প্রথম শ্রেণি অতি উঁচু স্তরের এবং দ্বিতীয় শ্রেণি অতি নিচু স্তরের। ভারতের সবচেয়ে বড় দেবতা ব্রহ্ম (ঈশ্বর) মানুষের এই শ্রেণিটাকে তার মাথা থেকে সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং তারা অভিজাত ও মনিব; আর মানুষের ওই শ্রেণিটাকে তার পা থেকে সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং তারা নীচ ও সেবাদাস। অবশিষ্ট সবাই বড় দেবতার হাতের সৃষ্টি, সুতরাং তারা মধ্যবর্তী স্তরের। স্বাভাবিকভাবেই এমন অপবিশ্বাসের পরিণতি ছিল মানুষের বংশ ও গোষ্ঠী অনুযায়ী নানা বর্ণে ও নানা স্তরে বিভক্ত সমাজ। মানুষের সমতার, মানবম-লীর শ্রেষ্ঠত্বের এবং সমানাধিকারের মূলনীতির কোনো অর্থই এখানে প্রযোজ্য নয়। দুনিয়া তখন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রের আভিজাত্য প্রদর্শনের কুরুক্ষেত্র ছিল।’ (সাইয়িদ সুলাইমান নদবী, আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ : ৪/৫২৩) সাইয়িদ সুলাইমান নদবী (রহ.) তারপর ইসলামের মহত্ত্ব প্রসঙ্গে আলোচনা করে বলেনÑ যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটল, অন্ধকার টুটে গেল। মানুষ প্রথমবারের মতো তাওহিদের বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে পারল। মানবিক ভ্রাতৃত্বের অর্থ তাদের বোধগম্য হলো। এ ভ্রাতৃত্ব মানুষের মধ্যে কোনো বিভাজন রাখে না এবং কৃত্রিম মানদ-ের বিনাশ ঘটায়। এ বিশ্বাসের কল্যাণে মানুষ সমতার ক্ষেত্রে তার লুণ্ঠিত অধিকারের কথা বুঝতে পারল। এই বিশ্বাসের কী ইতিবাচক কার্যকরী ফলপ্রাচুর্য রয়েছে, সে ব্যাপারে ইতিহাস শ্রেষ্ঠ সাক্ষী। যেসব জাতিগোষ্ঠী স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই বিশ্বাসের কল্যাণ মেনে নিয়েছে, তাদের চিন্তাধারায়ও এর প্রভাব রয়েছে। যদিও তারা এর যাবতীয় তাৎপর্য ও বিদ্যমান মান ও মানদ-ের পরিবর্তনে এর বাস্তবিক প্রয়োগের ব্যাপারে অজ্ঞ রয়েছে। অর্থাৎ যেসব জাতিগোষ্ঠী তাওহিদের মূলনীতিতে বিশ্বাসী নয়, তারা আজ পর্যন্ত মানবসমাজে সমতা বিধানের জন্য উপযোগী এই মূলনীতির অভাবে রয়েছে। আপনি তাদের সমাজব্যবস্থা ও সংঘ-সমিতিতে এ অভাবের দৃশ্যমান রূপ দেখতে পাবেন। এমনকি আপনি তাদের উপাসনালয়েও সমতা দেখতে পাবেন না, যেখানে তাদের নেতারা মানুষকে তাদের অবস্থান অনুযায়ী মর্যাদা প্রদানের ভিত্তিগুলোর মুখোমুখি হয়ে থাকে। কোনো সন্দেহ নেই যে, মুসলমানরা ভালো অবস্থায় রয়েছে। তেরো শতাব্দী ধরে তারা এই মূলনীতির সঙ্গে পরিচিত। সর্বোচ্চ ও সর্বশক্তিমান রবের একত্বের ওপর বিশ্বাসের কল্যাণ তাদের সঙ্গে রয়েছে। মানুষের মধ্যে স্তরবিন্যাসের কৃত্রিম মানদ- ও মানবসৃষ্ট নীতি থেকে তারা মুক্তি পেয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ চিরুনির দাঁতের মতোই সমান ও সমকক্ষ। বর্ণ বা ভূমি তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে না। জাতীয়তা ও দেশাত্মবোধ তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে পারে না। যখন তারা তাদের রবের সামনে থাকে, তখন তারা সিজদাবনত, বিনীত, রিক্ত ও দীন-হীন। আবার যখনই তাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকা-ে প্রবেশ করে, তখন তারা সবাই সম্মানিত, সবাই সমান। ঈমান ও বিশ্বাস বাদে তাদের মধ্যে পার্থক্যের আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। আমল ছাড়া তাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্বও নেই। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলেনÑ ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি।’ (প্রাগুক্ত, ৪/৫২৩)। এই একত্ববাদের দ্বারা মুসলমানরা তাদের স্রষ্টা, বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও তার নিয়ন্ত্রকের কাছে একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ফলে তাদের সভ্যতা ও মানবীয় জীবনযাত্রায় তাদের ক্ষেত্রে এই একত্ববাদের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 − two =