দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে টাঙ্গাইলের ১০ নদী

6
1065

টাঙ্গাইলের নদী খাল বিলগুলো ক্রমাগত ভরাট হয়ে দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদীও এখন প্রায় সরু খালে পরিণত হয়েছে। মিল-কারখানার বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে জলজ প্রাণি প্রায়ই নদীতে ভেসে উঠছে। স্থানীয়দের অসচেতনতা ও প্রভাবশালীদের দখলি প্রতিযোগিতায় নদী খালগুলো ঘরবাড়ি, প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও আবাদি জমিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া ১০টি বড় নদীর মধ্যে শুধুমাত্র যমুনা এখনও তার প্রমত্তা ধরে রেখেছে।

 

 

আর ধলেশ্বরী, বংশাই, লৌহজং, খিরু, যুগনী, ফটিকজানি, এলেংজানি, লাঙ্‌গুলিয়া ও ঝিনাই এবং শাখা নদীগুলো দখল-দূষণে খালে পরিণত হয়েছে। অথচ এসব নদীগুলোই এক সময় জীবনাচারের নিত্যসঙ্গী ছিল। বংশী বা বংশাই নদী পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। এটির দৈর্ঘ্য মোট ২৩৮ কিলোমিটার। নদীটি জামালপুর জেলার শরীফপুর ইউনিয়ন অংশে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলা অতিক্রম করে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি সাভারের কর্ণতলী নদীর সঙ্গে মিলে কিছু দূর প্রবাহিত হয়ে আমিনবাজারে এসে তুরাগ নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তুরাগ নদী আরো কিছু দূর প্রবাহিত হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। বংশাই নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৩৮ কিলোমিটার। এ নদী চারটি জেলা যথাক্রমে জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকা এবং ১০টি উপজেলা যথাক্রমে জামালপুর সদর, মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী, বাসাইল, মির্জাপুর, সখিপুর, কালিয়াকৈর, ধামরাই, সাভার এবং ৩২১টি মৌজার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ঝিনাই নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের শেরপুর, জামালপুর এবং টাঙ্গাইল জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭৬ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী নং-২১। ঝিনাই নদী জামালপুরের বাউশী থেকে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে একটি শাখা ডানদিকে বেঁকে যমুনার পূর্ব পাশ দিয়ে ভুঞাপুর উপজেলার ৭ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে কালিহাতী উপজেলার জোকার চরে ধলেশ্বরীর উৎসমুখের কাছে মিলিত হয়েছে। অপর শাখা দক্ষিণ-পূর্বমূখী হয়ে বাসাইল উপজেলার ফুলকী হয়ে বংশাই নদীতে পতিত হয়েছে। অন্য অংশ দক্ষিণমুখী হয়ে বাসাইলের ফুলকী-আইসড়া, দেউলী, দাপনাজোর, নথখোলা হয়ে দক্ষিণমুখী হয়েছে। প্রমত্তা যমুনা-ধলেশ্বরী বেষ্টিত ব-দ্বীপ বিশেষ নাগরপুর উপজেলা। জনশ্রুতি আছে, সুলতান মাহমুদ শাহর শাসনামলে নাগরপুরের মামুদ নগর ছিল তার রাজধানী। সেখানে তার একটি বিশাল এক নৌঘাঁটি ছিল। বিদেশি শত্রুর আক্রমণের হাত থেকে ওই অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্যেই সম্রাট মাহমুদ শাহ ওই নৌঘাঁটি নির্মাণ করেছিলেন। এক সময় বর্তমান সিরাজগঞ্জের চৌহালীর পূর্বাংশ, নাগরপুর এবং দৌলতপুরের অংশ বিশেষসহ পুরো এলাকা ছিল নদী এলাকা। কালের বিবর্তনে ওই এলাকা চর এলাকায় রূপ নেয়। নাগরপুরের নোয়াই নদীর দুই পাড় ইতোমধ্যে দখল হয়ে গেছে। মির্জাপুরের হাঁটুভাঙ্গা এলাকায় নদী দখল করে ১০-১৫টি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। বাসাইলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশাই নদীর দুই পারে গড়ে উঠেছে ইটভাটা ও রাইসমিল। লাঙ্‌গুলিয়া নদী পাড়ের বিশাল এলাকাজুড়ে বানানো হয়েছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। অনেক জায়গায় বাঁধ দিয়ে চলছে মাছ চাষ। কালিহাতীর বংশাই, সাপাই, ঝিনাই, ফটিকজানি, লাঙ্‌গুলিয়া ও নাংলাই নদীর দু’পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ঘরবাড়ি, মিলকারখানা ইত্যাদি। গোপালপুর উপজেলা সদরের বৈরান নদীর অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশে পুরোটাই বোরোর আবাদ হয়। গোপালপুর পৌরসভার অংশে নদীর উভয় পাড় দখল করে বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে ভূমিদস্যুরা। ভুঞাপুর ও বাসাইল উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝিনাই ও বংশাই নদী। বাসাইলের লাঙ্‌গুলিয়া নদী, মধুপুরের টোকনদী, গোপালপুরের বৈরান নদী, কালিহাতীর নিউ ধলেশ্বরী, এলেংজানি, ফটিকজানি, মির্জাপুরের বংশাই এক সময় ছিল খরস্রোতা। প্রমত্তা এসব নদী দিয়ে মহাজনী নৌকা চলাচল করত। নদী পাড়ের জেলেসহ অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এসব নদীর অধিকাংশই পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে নদীর বেশিরভাগ জায়গা। নদী দখল করে কোথাও পাকা ইমারত, কোথাও ইটভাটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, এমনকি আবাদি জমি বানিয়ে রীতিমতো ধান চাষ করা হচ্ছে। জেলার খালগুলো সবচেয়ে বেশি দখলের শিকার হয়েছে। সদর উপজেলার গালা বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত গালা খাল দখল হয়ে অত্যন্ত সরু হয়েছে। জেলার খালগুলো সবচেয়ে বেশি দখলের শিকার হয়েছে। সদর উপজেলার গালা বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত গালা খাল দখল হয়ে অত্যন্ত সরু হয়েছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ জানান, টাঙ্গাইল জেলা বিভিন্ন স্থানে অনেক নদী, খাল, বিল রয়েছে। বাসযোগ্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী, খাল, বিল অপরিসীম ভূমিকা রাখে। ধলেশ্বরী, নিউ ধলেশ্বরী, লৌহজং, এলেংজানি, ঝিনাই নদীতে প্রতি বছর পলি জমে। ওই পলি কেটে নেয়া এবং অপরিকল্পিতভাবে মাটি-বালু উত্তোলনের ফলে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন হয়। তিনি জানান, নিউ ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত অবাধ পানি পবাহ নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অগ্রাধিকারভিত্তিক ‘বুড়িগঙ্গা নদী খনন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়েছে। নদী খনন করার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হয়েছে, দ্রুতই কাজ শুরু হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × 5 =