এতসব প্রকল্প আর কর্মসূচির পরও বাস্ত্মবিক অর্থে কোনো উন্নয়নই হয়নি

0
568

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সব পর্যায়েই ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার মানোন্ননে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হলেও বাস্ত্মবিক অর্থে এর কোনো সুফল মিলছে না। তাই পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় এ সব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা আগের মতোই খারাপ করেছে। এ ব্যাপারে সংশিস্নষ্ট প্রশাসনের কাছে জানতে চাইলে তারা দায়সারা বক্তব্য দিয়ে গাঁ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। দশ বছরমেয়াদি এক বিশাল প্রকল্প (সেকায়েপ) গত বছরই তার মেয়াদ শেষ করেছে।

এ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ইংরেজি, অংক ও বিজ্ঞানে ছেলেমেয়েদের বিশেষভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা। অথচ প্রকল্প শেষ হওয়ার পরের বছরই এসএসসি পরীক্ষার ফলে দেখা যায়, গত প্রায় এক দশরে মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছে মাত্র ৭৭.৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। যা গত প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর তার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সেই আগের অংক ও ইংরেজিতে বিপর্যই ফলাফল খারাপের একমাত্র কারণ। যদিও সরকারের দাবি, খাতা মূল্যয়নে কড়াকড়ির কারণে ফলাফল খারাপ হয়েছে। কিন্তু একই বছরের পরীক্ষার ফল থেকে দেখা যায়, শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল গত বছরের চেয়ে রেকর্ড ২১ শতাংশ বেশি পাস করেছে। শিক্ষা সংশিস্নষ্টদের অভিমত খাতা মূল্যয়ন পদ্ধতিই যদি এর একমাত্র কারণ হতো তবে একটি শিক্ষা বোর্ডে এমন অলৌকিক ফল হতো না। যদিও অন্যসব শিক্ষা বোর্ডেই ফলে বিপর্যয় ঘটেছে। সেকায়েপ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও বর্তমানে মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিসহ আরও প্রায় দেড় ডজন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর প্রায় সবগুলোই কোন না কোনোভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে অংক ও ইংরেজির মানোন্নয়নে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই নির্দিষ্ট কার্যক্রম রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেও রয়েছে কয়েক ডজন প্রকল্প। এতসব প্রকল্প আর কর্মসূচির পরও বাস্ত্মবিক অর্থে অংক ও ইংরেজিতে বলার মতো কোনো উন্নয়নই হয়নি। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত্ম দেশের ১২৫টি উপজেলায় ‘সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট’ (সেকায়েপ) প্রকল্পের কাজে হাত দেয়। পরে আরও ৯০টি উপজেলায় সম্প্রসারণ করে এবং তৃতীয় পর্যায়ে আরও ৩৫ উপজেলায় সম্প্রসারণ করে মোট ২৫০টি উপজেলায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত্ম এ কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন। বিশেষ করে অংক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানের মানোন্নয়নে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এর আওতায় সারাদেশে প্রায় ছয় হাজার অতিরিক্ত শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন এ সব শিক্ষক ইংরেজি, অংক ও বিজ্ঞান বিষয়ে অতিরিক্ত প্রায় দেড় লাখ ক্লাস নিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কেন এই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করতে পারছে না তা সুস্পষ্ট কোনো জবাব শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ইংরেজি, অংক এবং বিজ্ঞান বিষয়ের মানোন্নয়নে দশ বছরমেয়াদি সেকায়েপ প্রকল্প হাতে নেয়া এবং একই সঙ্গে অন্য আরও একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে এ সব বিষয়ের উন্নয়নের চেষ্টা করার পরও কেন অংক ও ইংরেজিতে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করতে পারছে না এ প্রশ্ন ছিল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। এর উত্তরে মন্ত্রী নুরম্নল ইসলাম নাহিদ বলেন, সেকায়েপ প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তারা এখনো দেশের সব উপজেলায় এর বিস্ত্মার ঘটাতে পারেননি। এ ছাড়া ভালো মানের ইংরেজি, অংকের শিক্ষক পাওয়াটাও কষ্টসাধ্য। তবে কেন এ সব বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে ফল খারাপ হচ্ছে তা জানার জন্য আরও ভালো বিচার-বিশেস্নষণ করা দরকার। তারপরই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে। শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্যে খুশি হতে পারেননি দেশের শিক্ষা সংশিস্নষ্টরা। একাধিক শিক্ষাবিদ জানিয়েছেন, ২৫০টি উপজেলায় সেকায়েপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে সেখানেও অংক, ইংরেজিতে খারাপ ফল অন্যান্য অঞ্চলের মতোই। ফলে এ প্রকল্পের কোনো সুফল বাস্ত্মবিক অর্থে পরিলক্ষিত হয়নি বলেই তাদের অভিমত। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ সৌমিত্র শেখর বলেন, প্রকল্পতো একের পর এক আছেই। কিন্তু ইংরেজি ও অংকের ফল এতো কিছুর পরও সন্ত্মোষজনক নয়। এ বিষয়ে আরও বস্ত্মব সম্মত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। আরেক শিক্ষাবিদ মহিতুল ইসলামের দাবি, প্রকল্প নেয়া হয় বটে, কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এগুলো সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করাই প্রধান বিষয়। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবর প্রায়ই খবরে আসে। অনেক ক্ষেত্রে মাঠের শিক্ষকরা সঠিকভাবে ক্লাস নিচ্ছেন কি নিচ্ছেন না তাও নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। আর তার চেয়ে বড় বিষয় হল- এ শিক্ষকদের ক্লাসে পাঠানোর পূর্বে যথার্থ প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় গাফিলতি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারম্নজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, অনেক প্রকল্পই নেয়া হয়, কিন্তু শিক্ষকদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটিতে বরাবরই গাফিলতি থেকে যায়। যে কারণে প্রকল্পের পর প্রকল্প শেষ হলেও কাজের কাজ খুব কমই হয়। এ ছাড়া এখন শিক্ষা হয়ে গেছে অনেকটা কোচিংনির্ভর বাণিজ্যিক বিষয়। শিক্ষকদের একটি অংশের মধ্যে অধিক আয়ের প্রবণতা রয়েছে। আর সে আয় করতে গিয়ে তারা নীতি-নৈতিকতা বিরোধী পথে হাঁটতেও পিছপা হচ্ছেন না। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ১৫টি প্রকল্পের ধীরগতি নিয়ে তীব্র অসন্ত্মোষ প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়। এ সব প্রকল্পের চলতি অর্থবছরে খরচ হওয়ার কথা ৩ হাজার ৪৯২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। কিন্তু সেখানে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ৪২ শতাংশ অর্থ। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাউশিতে প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে এক বৈঠক করে এ সব প্রকল্পের সব টাকা আগামী তিন মাসে খরচ করতেও আদেশ দেয়া হয়েছে। শিক্ষা সংশিস্নষ্টরা বলছেন, মাঠের অবস্থার খোঁজ না নিয়ে জোর করে টাকা খরচের বাধ্য করলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া হয়। এ ছাড়া এমন ক্ষেত্রে অর্থের অপচয়েরও সম্ভাবনা থাকে বেশি থাকে। এভাবে চাপ দিয়ে টাকা খরচ করানো এবং হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের পরও অংক ও ইংরেজিতে মান কেন বাড়ানো যাচ্ছে না তা জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মান্নান এ বিষয়ে  বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়নে অনেক কাজই করা হচ্ছে। অনেক প্রকল্পও হাতে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এর পরও কেন ফলাফল ভালো করা যাচ্ছে না তা বের করার জন্য একটি তথ্যভিত্তিক গবেষণা করা দরকার। কারণ শিক্ষার উন্নয়নের সঙ্গেই আমাদের সব উন্নয়ন অগ্রগতি নির্ভর করছে। তবে আবছা আবছা ধারণার উপর ভর করে কোনো মন্ত্মব্য করাটা মনে হয় সমীচীন হবে না।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eighteen + thirteen =