স্টাফ রিপোর্টারঃ
পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল গত ৪ বছর ধরে বিনাটেন্ডারে আদায় করে আসছে সড়ক ও জনপদের ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী মামুনুর রশীদ ও কেরানীগঞ্জ উপ-প্রকৌশলী সৈয়দ আলম। মামুনুর রশীদ সিন্ডিকেটের প্রধান সৈয়দ আলম টোল আদায়ের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো মাসিক মাসোয়ারায় ম্যানেজ করে টোলের ইজারায় অংশগ্রহন থেকে বিরত রেখে নিজেরাই টোল আদায় করছেন আর সরকারকে ফাকি দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করছেন। মামুন সিন্ডিকেটের এহেন অপকর্ম অপরাধ বিচিত্রা সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে নড়েচড়ে বসেছে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ। উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের তোড়জোড়ে সেতুর টোল আদায়ের টেন্ডারের কার্যকক্রম শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে টোল আদায়ের টেন্ডার কল করা হলে তাতে আগামী তিন বছরের জন্য ২১ কোটি ২৯ লাখ টাকায় দরপত্র জমা দিয়েছে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু আরো বেশী মুল্য উঠবে বলে এটাকে স্থগিত করে রেখেছে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ। তিন বছরে যদি ২১ কোটি টাকা টোল আদায় হয় তাহলে পেছনের ৪ বছরে কত টাকা আদায় হয়েছে তা নিয়ে চলছে উর্ধ্বন মহলে ব্যাপক গবেষনা। তিন বছরে ইজারাদাররা ২১ কোটি টাকা দিতে পারলে সড়ক ও জনপদের নিজস্ব লোকেরা তার চাইতে ডবল টাকা দেয়ার হিসাব থাকলেও সেই টাকা গেল কোথায় এমন প্রশ্ন এখন সবার মনে। আর তাই টোল আদায়ের টেন্ডার কার্যক্রম যাতে সফল হতে না পারে তা নিয়ে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে মামুনুর রশীদ সিন্ডিকেটের কালো বিড়াল সৈয়দ আলম। অপরাধ বিচিত্রার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে অপকর্মের সেই চমকপ্রদ তথ্যচিত্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন নীতিমালায় তিন বছরের জন্য কয়েকবার টেন্ডার আহ্বানেও সাড়া দেননি কোনো ইজারাদার। কারন সৈয়দ আলম ইজারাদারদের আগেই মোটা অংকের টাকায় ম্যানেজ করে টেন্ডারে অংশগ্রহন থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছেন বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। লোক দেখানো টেন্ডারের চতুর্দশতম দরপত্র আহ্বানে একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু সেটা টোল আদায়ের টার্গেটের চেয়ে অনেক কম। ফলে পুনঃদরপত্র আহ্বান করলে সরকারের রাজস্ব আরও বাড়বে বলে আগের ইজারাদাররা জানান। কিন্তু সওজের কর্মকর্তা সৈয়দ আলম তার গুরু মামুনুর রশীদ সিন্ডিকেটের ইশারায় টেন্ডার প্রক্রিয়াটাকে দিনের পর দিন বানচাল করে আসছে বলে একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
১৯৮৯ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর পোস্তগোলা-কেরানীগঞ্জ হাসনাবাদের দুই পাড়ে নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। সেতুটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শুরু থেকে সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলরত যানবাহন ভেদে ১৩ ও ২০ টাকা হারে টোল নেওয়া হতো। এর পর এটা বৃদ্ধি করা হয় ২০ ও ৩০ টাকায়। কিন্তু হঠাৎ ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে যানবাহন ভেদে টোল বৃদ্ধি করা হয় কয়েকগুণ। সেই সঙ্গে টোলের আওতায় আনা হয় ছোট ছোট যানবাহনগুলোকে। ২০১৫ সালে অতিরিক্ত টোলের হার কমানো ও টোল ফ্রি করার দাবিতে আন্দোলন করে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। আন্দোলনকারীরা টানা কয়েকদিন বন্ধ করে দেন যান চলাচল। ফলে কর্তৃপক্ষ ছোট ও হালকা যানবাহনের টোলমুক্ত ও বর্ধিত ভাড়া কার্যকর স্থগিত করে। এ অবস্থায় টেন্ডার থেকে বিরত থাকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাসিক হারে চাঁদা দিয়ে তাদেরকে টেন্ডারে অংশগ্রহন থেকে বিরত রাখে। ফলে ৯০ দিনের জন্য টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় সড়ক ও জনপথ বিভাগের কেরানীগঞ্জ সড়ক উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ আলমকে। এই সুবাদে সৈয়দ আলম সারা দিনে টোল আদায় করে দুই লাখ টাকা আর সরকারের কোষাগারে জমা দেয় পঞ্চাশ হাজার। বাকী টাকা ভাগবাটোয়ারা করে মামুনুর রশীদ। এভাবে দীর্ঘ পৌনে চারবছর অতিবাহিত হলেও কোনো টেন্ডার দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি নেওয়াও হচ্ছে না বর্ধিত অর্থ। সড়ক ও জনপথের হিসাব অনুযায়ী সর্বশেষ টোল আদায় করা হয় চার কোটি ৬৬ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ১৪তম টেন্ডার আহ্বান করলে একটি ইজারাদার প্রতিষ্ঠান তিন বছরের জন্য সাবমিট করে ২১ কোটি টাকা। বছরে ৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঐ প্রতিষ্ঠান সরকারের কোষাগারে বছরে ৭ কোটি টাকা জমা দিয়ে তারপরে নিজেরা লভ্যাংশ ঘরে তুলবে। সেক্ষেত্রে মামুনুর রশীদ সিন্ডিকেট বছরে কত কোটি টাকা টোল আদায় করে ছিল তার কোন সঠিক হিসাব কারোর কাছে নেই। অবশেষে টোলের টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর সপ্তম কলে দু-বছর ইজারা পরিচালনাকারী মেসার্স চৌধুরী ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ চার কোটি ২০ লাখ ও অষ্টম কলেও সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকার পুনঃদরপত্র জমা দিলে তাতেও সাড়া দেয়নি মামুনুর রশীদ সিন্ডিকেট।
অন্যদিকে নিউ ভিশন নামক প্রতিষ্ঠান পাঁচ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দরপত্র জমা দেয়, যা সড়ক ও জনপথের টোল আদায়ের অর্থে চেয়ে প্রায় এক কোটি টাকা বেশি। এরপরও ২৭ সেপ্টেম্বর-১৭ নবম দরপত্র আহ্বানের দিন ধার্য করা হলেও নতুন করে বাড়তি হারে তিন বছরের জন্য টেন্ডার আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে বাতিল করা হয় আগের জমা পড়া দরপত্র। এদিকে নতুন নীতিমালায় তিন বছরের জন্য পরপর চারটি টেন্ডার আহ্বান করা হলেও কোনো ইজারাদার কোনো দরপত্রে অংশ নেননি। ইজারা না নিয়েই ইজারাদার যদি ঘরে বসে মাসে মাসে মোট টাকা কমিশন পায় তাহলে টাকা খরচ করে ইজারা নেয়ার কি দরকার। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে অপরাধ বিচিত্রার ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের পরে চতুর্দশ কলে ২১ কোটি ২৯ লাখ টাকায় দরপত্র জমা দেন একমাত্র কে.আলম শিপিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি যাতে ইজারা না নিতে পারে তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে সৈয়দ আলম। সৈয়দ আলমের দাবী তিন বছরে ইজারা থেকে রাজস্ব আসবে অন্তত ৩৬ কোটি টাকা। সড়ক ও জনপথের জরিপ বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়তি দরের হিসাব অনুযায়ী তিন বছরে টোল আদায়ের পরিমাণ হবে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। আলাপকালে আগের এই টোল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কয়েক ইজারাদার জানান, আবারও পুনঃদরপত্র আহ্বান করলে সরকারের মোটা অঙ্কের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। ফলে পুনঃদরপত্র আহ্বান করা উচিত বলে মনে করেন তারা। অন্যদিকে দ্বিতীয় সেতুর টোল ফ্রি করে দেওয়ার আন্দোলন করে সফল হয় কেরানীগঞ্জবাসী। দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল আদায় ফ্রি করে দিয়ে সরকার শত শত কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দ্বিতীয় সেতুর টোল ফ্রি করায় যাত্রীদের কোনো উপকারে আসেনি। সুযোগ নিচ্ছে কেরানীগঞ্জের পরিবহন চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীরা।
এব্যাপারে কেরানীগঞ্জ উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সৈয়দ আলমের নিকট জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদনকে হুমকি দিয়ে বলেন, বেশী বাড়াবাড়ি করবেন না। এটা করলে ফলাফল ভালো হবে না। আপনে কিসের সাংবাদিক। আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার ধারনা নাই। সড়ক ও জনপদে চাকুরী না করলে অনেক বড় সাংবাদিক হতে পারতাম। বড় বড় সাংবাদিকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক। টোলের টাকার ভাগ পায় স্থানীয় এমপি, রাজনৈতিক নেতারা, পারলে তাদের সম্পর্কে লিখুন।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ ঢাকা বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মামুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।