ক্রেতার অভাবে তারা সেই ধান কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে

0
739

দেশের মধ্যে সর্বাধিক ধান উত্পাদন হয় ময়মনসিংহ জেলায়। মাটির উর্বরা শক্তি, অনুকূল আবহাওয়াসহ নানা কারণে এই জেলায় মোট ধানের সাড়ে ১০ শতাংশ উত্পাদিত হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধান উত্পাদনকারী জেলা হিসেবে রয়েছে রংপুর। এই জেলায় উত্পাদন হয় মোট ধানের ৯.৬ শতাংশ। অথচ এই দুই জেলার কোনোটিতেই সরকারের ধান কেনার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

খাদ্য অধিদপ্তর সব জেলা থেকে ধান কেনার অনুমোদন চাইলেও নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে খাদ্য মন্ত্রণালয় তা আটকে দিয়েছে। মন্ত্রণালয়টি ৯টি জেলা থেকে ধান কেনার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জ থেকে তিন হাজার টন, সুনামগঞ্জ থেকে ছয় হাজার টন, বরিশাল থেকে এক হাজার ৪২০ টন, ঝালকাঠি থেকে ২২০ টন, পিরোজপুর থেকে ৫৪০ টন, ভোলা থেকে এক হাজার ৫৪০ টন, পটুয়াখালী থেকে ৩০০ টন, বরগুনা থেকে ৭০ টন এবং কিশোরগঞ্জ থেকে দুই হাজার ২০০ টন। দেশের প্রায় এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক তাদের উত্পাদিত ধান নিয়ে বর্তমানে বাজারে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রেতার অভাবে তারা সেই ধান কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ খাদ্য অধিদপ্তর মাত্র ৯টি জেলা থেকে ধান ক্রয় করায় বাজার চাঙ্গা হচ্ছে না। কঠোর বাস্তবতা হলো, বর্তমানে খাদ্য অধিদপ্তর ধান না কিনে যখন কিনতে যাবে, তখন প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের হাতে আর ধান থাকবে না। এসব কৃষক ফসল ওঠার পরপরই কম দামে ধান বিক্রি করে দিয়ে কৃষিঋণের টাকা পরিশোধ করে। বছর শেষে গোলার ধান ফুরিয়ে গেলে বাজার থেকে তারা চাল কিনে খায়। ওই সময়টায় বাজারে চালের দাম বেশি থাকে। অর্থাৎ বাজারে যখন দাম কম থাকে তখন এই কৃষকরা তাদের উত্পাদিত ধান বিক্রি করে কৃষি উত্পাদনের খরচ পরিশোধ করে। বাজারে যখন দাম বেড়ে যায় তখন কিনে খায়। এমন জটিলতায় রয়েছে দেশের প্রায় এক কোটি কৃষক ও তাদের পরিবারের প্রায় পাঁচ কোটি সদস্য। এমন পরিস্থিতিতে এখনই বাজার থেকে সরকারের ধান-চাল কেনার প্রকৃত সময়। কিন্তু সরকার কেন কিনছে না, বিষয়টি জানতে চাইলে খাদ্যসচিব শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এখন ধান ভেজা। এসব ধান কিনে গুদামজাত করা হলে চালের মান খারাপ হবে। আমরা ধীরে ধীরে বাজার থেকে ধান ও চাল সংগ্রহ করব। এই সংগ্রহের জন্য আগস্ট পর্যন্ত সময় আছে।’ কিন্তু দেশের বেশির ভাগ প্রান্তিক কৃষক বর্তমানে বাজারে ধান বিক্রি করে দিচ্ছে। এই সময় খাদ্য অধিদপ্তর বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করলে কৃষক বেশি দাম পেত কি না, এমন জানতে চাইলে খাদ্যসচিব বলেন, ‘ধান-চাল কেনার পুরো প্রক্রিয়াটি দেখে খাদ্য অধিদপ্তর। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব।’ খাদ্য অধিদপ্তর ধান-চাল কিনলেও অনুমোদন দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তর সারা দেশ থেকে একযোগে ধান-চাল কেনার অনুমোদন চাইলেও মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে মাত্র ৯ জেলা থেকে কেনার। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, যে ৯টি জেলা থেকে ধান কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলোর কোনোটিই প্রধান ধান উত্পাদনকারী জেলা নয়। অথচ এসব জেলার পছন্দসই মিলারদের সঙ্গে ধান কেনার চুক্তি করা হয়েছে। ময়মনসিংহ, রংপুরসহ অন্য ধান উত্পাদনকারী জেলাগুলোর মিলারদের সঙ্গে দরকষাকষি চলছে। যখনই এই দরকষাকষি মন মতো হবে তখনই অবশিষ্ট জেলা থেকে ধান কেনার অনুমতি দেওয়া হবে। মিল থাকলেই ধান-চাল সংগ্রহের বরাদ্দ পাওয়া যায় না। বরাদ্দ পেতে নানা ‘কাঠখড়’ পোড়াতে হয় মিলারদের। হাওরের জেলাগুলোর ৯৯ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে গত সপ্তাহেই। অথচ কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ ছাড়া অন্য জেলাগুলোতে এখনো ধান কেনা শুরু হয়নি। ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনার মতো ধান উত্পাদনে পিছিয়ে পড়া জেলা থেকে ধান কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অথচ সমুদ্র উপকূলীয় এসব জেলায় খুব কম ধান উত্পাদন হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ধান-চাল কেনার অনুমোদন দেয় খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি (এফপিএমসি)। এ কমিটি গত ৮ এপ্রিল বৈঠক করে প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য ২৬ টাকা এবং ৩৮ টাকা দরে চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। কমিটি গত ২ মে থেকে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। এই সময়ের মধ্যে ৯ লাখ টন চাল এবং দেড় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ আরো বেশ কজন মন্ত্রী এই কমিটির সদস্য। তাঁরা ধান-চাল সংগ্রহের সময় ও লক্ষ্যমাত্রা অনুমোদন করলেও খাদ্য অধিদপ্তর ধান-চাল কেনা শুরু করতে পারে না। তাদের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। সেই অনুমোদনের গ্যাঁড়াকলে পড়ে বর্তমানে বাজার থেকে পুরোদমে ধান কিনতে পারছে না খাদ্য অধিদপ্তর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি সূত্রে জানা গেছে, দেশে ধানের উত্পাদন তিন কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে ময়মনসিংহে উত্পাদন হয় ৩৫ লাখ ২৩ হাজার টন, যা মোট উত্পাদনের প্রায় ১০.৪০ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধান উত্পাদনকারী জেলা হচ্ছে রংপুর। এ জেলায় বোরো ধান উত্পাদন হয় ৩২ লাখ ৫৬ হাজার টন। একজন মিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কৃষকদের কাছ থেকে সরকারের ধান কেনার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো। গত বছর কৃষকের কাছ থেকে সাত লাখ টন ধান কেনা হলেও এবার সেটি দেড় লাখ টনে নামিয়ে আনা হয়েছে। গত বছর যারা ধান সরবরাহ করেছে তারা সবই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। আমাদের মতো সাধারণ মিলাররা ধান সরবরাহ করতে পারেন না। আমাদের কাছে খাদ্য অধিদপ্তর যখন আসে তখন বাজারে চালের দাম অনেক বেশি থাকে। সরকার নির্ধারিত দামে চাল না পেলেই আমাদের কাছে তারা আসে।’ খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক এক মহাপরিচালক বলেন, ‘মুখ চিনে ধান-চালের অর্ডার দেওয়ার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। এভাবে সব সময়ই একটি চক্র শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। শুধু ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের সময় নয়, গমও এ থেকে বাদ যায় না। বিভিন্ন এলাকার সংসদ সদস্যরা তাঁদের প্যাডে ডিও লেটার দিয়ে বিভিন্ন মিলারের পক্ষে তদবির করেন। যদি কোনো স্বার্থই না থাকবে তাহলে সংসদ সদস্যরা এমনকি মন্ত্রীরাও ডিও লেখার দেন কেন?’ হাওর অঞ্চলের একজন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেন, ‘গত বছর হাওর অঞ্চলের ১০ লাখ একরের বোরো ফসল অকাল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এবার স্বাভাবিকভাবেই হাওরের কৃষকরা চেয়েছিল ভালো দামে তাদের উত্পাদিত ধান কেনা হবে। ভালো দাম তো দূরের কথা, এখনো ধান কেনাই শুরু করেনি সরকার। তিনি হাওরের ধান বিশেষ দামে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনার পরামর্শ দেন। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার তাঁর দপ্তরে  বলেন, ‘আমরা কয়েকটি জেলার ধানের বিভাজন করে দিয়েছি। ধান উত্পাদনকারী সব জেলা থেকে একসঙ্গে না কেনার কারণ হচ্ছে ধান এখনো ভেজা। এ ধান কিনে গুদামে নেওয়া হলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি এ কারণে গুদামে রক্ষিত অন্য ধান-চালও নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তা নির্ধারিত সময়ে পূরণ করা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

four − two =