নগরের অক্সিজেন থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে মোড়ে মোড়ে যানজট। সড়কের বেশির ভাগ অংশই ভাঙাচোরা তছনছ। ১০ মিনিটের পথ যেতে দেড়-দুই ঘণ্টা এমনকি কখনো কখনো আরো বেশি সময় লাগে। এ কারণে চট্টগ্রাম জেলার রাউজানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন নগরের বহদ্দারহাট থেকে গার্মেন্টসামগ্রী কিনতে ওই সড়ক এড়িয়ে অক্সিজেন কুয়াইশ সংযোগ সড়ক দিয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় আসেন গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায়।
সেখানে সড়কের মাঝ বরাবর চলছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপ বসানোর কাজ। এতে কাপ্তাই রাস্তার মাথার তিন রাস্তার মোড়ে তীব্র যানজটে পড়েন সাহাব উদ্দিন। নগরের প্রধান সড়কের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় সেদিন একইভাবে যানজটে আটকা পড়েন আরো অনেকে। সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘আমার কপাল খারাপ। বিকল্প সড়ক দিয়ে এসেছি যানজট থেকে রক্ষা পেতে। এখন এখানেও দেখছি একই অবস্থা। কোন দিক দিয়ে যাব। রমজানের দিন সকালে এত যানজট থাকলে মালপত্র কিনে আজকে ইফতারের আগে বাড়ি যেতে পারব বলে মনে হয় না।’ এই কথা শুনে সিএনজি অটোরিকশাচালক মো. জসীম বলেন, ‘এখন তো একটু কম আছে। ইফতারের আগে অবস্থা আরো খারাপ হয়। আমরা তো গাড়িই চালাতে পারি না। যানজটের কারণে ভাড়া বেশি টানতে পারি না। উনি (সাহাব উদ্দিন) এই দিকে আসতে বলেছেন তাই আসছি। আমি আসতাম না। যেখানে বেশি যানজট হয় আমি এখন সেদিকে ভাড়া কম নেই। যানজটের সড়কে গেলে বেশি ভাড়া সবাই দেয় না।’ সকাল সোয়া ১০টায় সেখানে যাত্রী ও পথচারীর দুর্ভোগের ছবি তুলতেই দেখা যায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট সোয়েব আহমদকে। ওই এলাকায় যানজটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিন-চার মাস ধরে এখানে যানজট। দেখেন, এখানে গাড়ি কোথায় চলবে? গাড়ি চলাচলের জায়গা আছে! এখানে ওয়াসার উন্নয়নকাজের কারণে রাস্তা ছোট হয়ে গেছে। তাই যানজট হচ্ছে।’ ট্রাফিক কনস্টেবল মহসিন সার্জেন্টের সামনে এসে বলেন, ‘আজকে তো আরো বেশি হবে যানজট।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজকে ওয়াসার কাজের কারণে রাস্তা আরো ছোট হয়ে গেছে, আবার বৃহস্পতিবার।’কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে বহদ্দারহাটের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। কাপ্তাই রাস্তার মাথায় যানজট আর ধুলোবালি। প্রধান এই সড়কের বাম পাশে পুরোটাই বন্ধ। সেখানে মোড়ে মোড়ে ওয়াসার পাইপ বসানোর কাজ চলছে। ডান পাশে একমুখী সব ধরনের যানবাহন চলছে। বাম পাশে বন্ধ সড়কের বিভিন্ন অংশে রাখা হয়েছে ট্রাক, সিএনজি অটোরিকশা, টেম্পোসহ বেশ কিছু যানবাহন। কালুরঘাট সিঅ্যান্ডবি এলাকা থেকে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালে বাস করে আসছিলেন গৃহবধূ ফাতেমা। পুরান চান্দগাঁও এলাকায় দীর্ঘ যানজট দেখে তিনি বাস থেকে নেমে যান। ওই সময় ফাতেমা বলেন, ‘বাস টার্মিনালের ভাড়া পাঁচ টাকা দিয়েছি। যে যানজট দেখছি তাতে মনে হচ্ছে অনেক সময় লাগবে। তাই হেঁটে চলে যাচ্ছি।’সেখানে একমুখী যানবাহন চলাচলের কারণে বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট দেখা যায়। সকাল সোয়া ১১টায় বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের সামনে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অনেক যাত্রী। তাদের একজন মুনির আহমেদ বলেন, ‘আমি যাব পতেঙ্গা কাটগড় এলাকায়। গাড়ির জন্য দাঁড়িয়েছি, কিন্তু পাচ্ছি না। গাড়ি নাকি যানজটে আটকে পড়েছে, কম আসছে। আমি ৪০-৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে আছে। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় অক্সিজেন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় যানজটের একই রকম চিত্র। কুয়াইশ সংযোগ সড়কের তিন রাস্তার মুখ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সামনে মাঝ রাস্তায় গোলাকৃতির বড় একটি অংশে ওয়াসার নির্মাণকাজ চলছে। বিশেষ করে মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন আসার পথে রাস্তার বাম পাশের গাড়িগুলোর চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বাসচালক মো. রফিক বলেন, ‘আমাদের কথা কেউ তো শোনে না। একটু লেখেন। মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন দিনের বেলায় আসতে এখন কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট লাগে। রাতে দেড়-দুই ঘণ্টা। যানজটের কারণে গাড়ি কম চালাই। শুধু যাত্রীদের না আমাদেরও কষ্ট হয় যানজটে।’ওই সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ঘেষে দাঁড়ানো ট্রাফিক কনস্টেবল দীপক মল্লিক বলেন, ‘এই একটি গর্তের কারণে সাত-আট মাস ধরে এখানে যানজট বেশি হচ্ছে।’ দুপুর সাড়ে ১১টার দিকে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারসংলগ্ন লালখানবাজার এলাকায় বাসের অপেক্ষায় ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। এই যুবক বলেন, ‘ফ্লাইওভার করেছে যানজট কমানোর জন্য; কিন্তু সেখানে তো গণপরিবহন ওঠে না। এখান থেকে মুরাদপুরের দূরত্ব তিন কিলোমিটার। কিন্তু ফ্লাইওভারের নিচে সড়ক দিয়ে মুরাদপুর যেতে এক ঘণ্টা লেগে যায়। ইফতারের আগে এবং সন্ধ্যার পর সময় আরো বেশি লাগে।’ দুপুর ১২টায় কাজীর দেউরি থেকে নিমতলা বিশ্বরোড তিন রাস্তার মোড়ে যাওয়ার পথে লালখান বাজার পেট্রল পাম্পের সামনে থেকে টাইগারপাস, দেওয়ানহাট থেকে আগ্রাবাদ, বারিক বিল্ডিং, ফকিরহাট সব এলাকায় দেখা যায় যানজট। এতে যাত্রীরা অতিষ্ঠ। নিমতলা বিশ্বরোড মোড়ে বন্দর সংযোগ সড়কের মুখ দিয়ে ঢুকতেই ডান পাশে ভয়াবহ যানজট। আর বাম পাশে এক কিলোমিটার এলাকায় সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। সেখানে ধুলোবালিতে যাত্রী ও পথচারীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে। কেউ নাক-মুখে হাত চেপে, কেউ মাস্ক পরে অথবা কাপড় মুখে দিয়ে চলাচল করছে। ধুলাবালি আর ভাঙাচোরা রাস্তায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দুপুর সোয়া ১২টায় নিমতলা মোড়ে সিএনজি অটোরিকশাচালক সোহাগ খান বলেন, ‘নিমতলা থেকে অলংকার যেতে ১৫ মিনিট লাগার কথা থাকলেও যানজটের কারণে এখন কমপক্ষে দুই ঘন্টা লাগে। এখানে গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না।’ফার্নিচার মিস্ত্রি মো. সেলিম বলেন, ‘এখানে পুরো সড়কই ভাঙা। আর রাস্তায় দেখেন কি ময়লা আবর্জনা। যানজটের কারণে সাত-আট ঘণ্টাও লাগে দুই-তিস কিলোমিটার এলাকা যেতে।’আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের নাদিয়া ফার্নিচারের সামনে রাস্তায় বড় বড় গর্ত আর পানি। কর্দমাক্ত সড়কে ‘গাড়ি চলে না চলে না’ অবস্থা। ওই সড়কের প্রায় তিন কিলোমিটার পথে দুর্ভোগের শেষ নেই। ফরহাদ হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, রাস্তায় হেঁটে যেতে পারি না। গাড়ি চললে রাস্তার ময়লা পানিতে কাপড়চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। ওই সড়কের বেশির ভাগ অংশে সংস্কারকাজের কারণে একমুখী যান চলাচল করছে।’ দুপুর ১টা থেকে পৌনে ২টা পর্যন্ত বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক ঘুরে সেখানেও ভয়াবহ যানজট দেখা যায়। সংস্কারকাজের কারণে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগেই আছে। বিকেলে নগরের চকবাজার, আন্দরকিল্লা, লালদিঘি, কোতোয়ালি মোড়, নিউ মার্কেট, এনায়েত বাজার, লাভলেইন, ২ নম্বর গেট এলাকায়ও চোখে পড়ে ভয়াবহ যানজটের দৃশ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘জাকির হোসেন রোডের দক্ষিণ খুলশী অভিজাত এলাকা থেকে কাজির দেউরির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। কিন্তু ১০ মিনিটের এই পথ আসতে পৌনে এক ঘণ্টা লেগেছে। কাজির দেউরি আসার সময় দেখি আশপাশে সব রুটেই ভয়াবহ যানজট।’ নগরের আরো বিভিন্ন সড়ক-উপসড়ক ঘুরে বেশির ভাগ সড়কেই যানজট দেখা গেছে। যত্রতত্র গাড়িতে যাত্রী ওঠানামা, প্রধান সড়কগুলোতে প্যাডেলচালিত রিকশা চলাচলের কারণে বড় গাড়ির গতি কমে যাওয়া, ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে গাড়ির গতি কমে যাওয়া, সড়কে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, পর্যাপ্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা না থাকা, এক রুটের গাড়ির অন্য রুটে যাত্রী পরিবহন, বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নকাজের কারণে সড়ক সরু হওয়া ও একমুখী চলাচল ইত্যাদি কারণে যানজট বেড়ে চলেছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন গত বৃহস্পতিবার বিকেলে নিজ কার্যালয়ে বলেন, ‘অনেকগুলো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে উন্নয়নকাজ করছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসার নগরজুড়ে পাইপলাইন বসানোর কাজ চলছে। যেখানে সেবা সংস্থাগুলোর কাজ শেষ হয় সেখানে ভাঙাচোরা সড়ক আমরা (সিটি করপোরেশন) দ্রুত মেরামত করে ফেলি।’মেয়র বলেন, ‘যানজট অনেক কারণে হচ্ছে। যানবাহন চলাচলের মতো প্রয়োজনীয় রাস্তা নেই। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানো, পার্কিং, অপরিকল্পিত নগরায়নসহ বিভিন্ন কারণে যানজট হচ্ছে। তবে ট্রাফিক বিভাগকে আরো তত্পর ও আন্তরিক হতে হবে। ট্রাফিকের মিসম্যানেজমেন্টের কারণেও অনেক জায়গায় যানজট হচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে। আমি গতকালও (বুধবার) পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে বসেছি। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে রাতারাতি যানজট কমানো সম্ভব হচ্ছে না।’অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘নগরের পোর্ট কানেকটিং, এক্সেস রোড, বহদ্দারহাট থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা, মুরাদপুর-অক্সিজেন, ২ নম্বর গেট-অক্সিজেন সড়কে উন্নয়নকাজের কারণে যান চলাচল প্রায়ই অচল হয়ে পড়ছে। অন্যান্য সড়কেও যানজট হচ্ছে। আমরা সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছি দ্রুত রাস্তাগুলো মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করার জন্য। সবাইকে একটু কষ্ট সহ্য করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’ তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক বিভাগের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। রাস্তা ও বিভিন্ন উন্নয়নকাজের কারণে সাময়িক দুর্ভোগ হচ্ছে।’চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘এবারের রমজানে যানজট আরো বেড়ে গেছে। বেশি যানজট হচ্ছে দেওয়ানহাট থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকায়। ওই এলাকায় যানজটের কারণে নগরের প্রধান সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগেই থাকে। নগর পুলিশের উদ্যোগে রমজানের আগে যানজট নিরসন নিয়ে যে বৈঠক করা হয়েছে তা আইওয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়। দিন দিন যানজট বাড়ছে। সামনে মার্কেটগুলোতে কেনাকাটা ঘিরে যানজট আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ট্রাফিক বিভাগ সক্রিয় নয়, যানজট নিরসনে তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।’চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী মঞ্জু বলেন, যানজটের কারণে উত্তর চট্টগ্রামের মানুষ বেশি কষ্ট পাচ্ছে। নগরে ঢুকেই উত্তরের মানুষ অক্সিজেন থেকে মুরাদপুর এবং বায়োজিদ বোস্তামী সড়ক দিয়ে ২ নম্বর গেট যেতে যানজটের কারণে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। দফায় দফায় রাস্তা কাটা হচ্ছে উন্নয়নকাজের জন্য। যেসব রাস্তা কাটা হয়েছে এখনো অনেক সংস্কার করা হয়নি। ভাঙা সড়কের কারণে গাড়ির মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে।