বিনিয়োগে ব্যাংকের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে মূলধন সংগ্রহের গ্রহণযোগ্য মাধ্যম পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নিতে আগামী বাজেটকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, একটি গতিশীল পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মূলধনের সহায়তায় পুঁজিবাজারকে গতিশীল করা খুবই জরুরি।
তাই আগামী বাজেটে এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকতে হবে। দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়াতে ভালো কম্পানির শেয়ারের জোগান বাড়াতে করপোরেট করে ছাড় দিতে হবে। পুঁজিবাজার গতিশীল করতে আগামী বাজেটে সুযোগ সুবিধা চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একগুচ্ছ প্রস্তাব জানিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন পরবর্তী ২০১৮-২০১৯ পর্যন্ত শতভাগ কর অব্যাহতি, সদস্যদের থেকে সংগৃহীত করহার হ্রাস, লভ্যাংশ আয়ের করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি, মানুষের করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও আকৃষ্ট করতে ভালো কম্পানি বাজারে আনতে করপোরেট করে ছাড় দেওয়ার পক্ষে প্রতিষ্ঠানটি। সূত্র জানায়, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কম্পানিতে করপোরেট করের ব্যবধান ১০ শতাংশ। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর ব্যবধান ২.৫ শতাংশ। মোবাইল ফোন কম্পানির কর ব্যবধান ৫ শতাংশ। পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়ে তালিকাভুক্ত হলে করপোরেট কর ২৫ শতাংশ আর অ-তালিকাভুক্ত কম্পানির ৩৫ শতাংশ। তালিকাভুক্ত হলে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে করপোরেট কর ৪০ শতাংশ আর তালিকাভুক্ত না হলে ৪২.৫ শতাংশ। অ-তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কম্পানিতে কর ৪৫ শতাংশ আর তালিকাভুক্ত হলে ৪০ শতাংশ। বাজেটের প্রাক্কালে নানা সুযোগ-সুবিধা চেয়ে প্রতিবছরই প্রস্তাব পাঠায় পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এবার পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিশ্বের প্রথম সারির চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যা পুঁজিবাজার সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেয়। এই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ভালো কম্পানির শেয়ারের জোগানের কোনো বিকল্প নেই। কিভাবে ভালো কম্পানির জোগান আসবে সেই বিষয়ে আগামী বাজেটে সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবি পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্টদের। ডিএসইর প্রস্তাব থেকে জানা যায়, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন স্কিমের আওতায় স্টক এক্সচেঞ্জের সংস্কার কার্যক্রমে পুঁজিবাজারের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত ১০০ শতাংশ কর অবকাশ চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এই তিন বছর যথাক্রমে ৬০, ৪০ ও ২০ শতাংশ হারে কর অবকাশ পাওয়ার কথা। ডিএসই বলছে, অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন পণ্য চালু, স্বল্প মূলধনী কম্পানির পৃথক লেনদেন চালুর মাধ্যমে সম্ভাবনাময় পুঁজিবাজার দীর্ঘ মেয়াদে একটি নতুন উচ্চতায় স্থান পাবে। দৈনিক লেনদেন ২৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত হবে। এতে সরকারের রাজস্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়েছে, তিন বছর ধরে আয়কর অব্যাহতির সীমা অপরিবর্তিত। এই সময়ে জীবনযাত্রা ব্যয়ের সূচক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই বর্ধিত জীবনযাত্রার ব্যয় সূচক এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য রেখে আয়কর মুক্তিসীমা একটি যৌক্তিক পর্যায় পর্যন্ত বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা ২.৫ লাখ টাকা থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে ডিএসই। তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট করে ছাড়ের ব্যবধান আরো বাড়ানোর পক্ষে ডিএসই। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কম্পানির মধ্যে করপোরেট আয়কর হারের পার্থক্য ১০ শতাংশ। কিন্তু এই হার বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা উচিত। করপোরেট কর কমালে বহুজাতিক ও স্থানীয় ব্লু-চিপ কম্পানি এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত হবে। দেশে ও পুঁজিবাজারে অধিক পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। রাজস্ব প্রণোদনার মাধ্যমে দেশে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উন্নত এবং অনুন্নত যেকোনো দেশে প্রচলিত ঘটনা বলে মনে করছে ডিএসই। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীর আস্থা বৃদ্ধিতে পুঁজিবাজারে ভালো কম্পানির শেয়ারের কোনো বিকল্প নেই। দেশে ব্যবসা করা বহুজাতিক কম্পানি বছরে ভালো মুনাফা করলেও বাজারে আসছে না। কিন্তু না এলেও বাধ্য করার মতো কোনো বিধান নেই। কাজেই করপোরেট করে ছাড় দিয়ে পুঁজিবাজারে আনতে হবে। আর সেটা বাজেটে ঘোষণা ছাড়া হবে না। যার জন্য আগামী বাজেটে করপোরেট করের বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে।’ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য ও ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীনের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কনসোর্টিয়ামের চুক্তিতে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এখন ভালো বা দৃঢ়ভিত্তির কম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে এসে ভালো কম্পানির জোগানই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে সরকারের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ থাকতে হবে। বাজেটে করপোরেট করে ছাড় দিয়েও বহুজাতিক কিংবা ভালো কম্পানিকে আনা যেতে পারে।’