কর্ণফুলী নদী রক্ষায় কোন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হয়নি

0
726

দখল, দূষণ ও নাব্যতা সংকটণ্ডদীর্ঘদিন ধরে এই তিন সমস্যায় আক্রান্ত কর্ণফুলী নদী। সমস্যাগুলোকে দূর করে নদীটিকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নানা পরিকল্পনার গল্প শুনিয়েছিল নানা সংস্থা। কিন্তু সেইসব পরিকল্পনার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। যা প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চট্টগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদীটিকে অস্তিত্বের সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের দখলদারদের উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা আছে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আবার নদীটিকে দূষণমুক্ত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। এদিকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প আছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। যদিও এখন পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর গৃহীত কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে মনে করেন নগরবাসী। অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ দখলদারদের অন্যত্র সরে যেতে সম্প্রতি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরে না গেলে জেলা প্রশাসন দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। আবার পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, দূষণ রোধে তারা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ড্রেজিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে চীন থেকে ড্রেজার আনা হয়েছে। এদিকে কর্ণফুলীকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করছে। ইতোমধ্যে মাস্টার প্ল্যানের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। আগামী মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠেয় এ সংক্রান্ত কমিটির সভায় মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। কর্ণফুলী গবেষক ও সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসীন কলেজের অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী দৈনিক  বলেন, দশ বছর আগে যে কর্ণফুলী ছিল সেই অবস্থায় এখন নেই। কারণ, বর্তমানে কর্ণফুলী নদী একাধিক প্রধান সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে দখল, দূষণ ও নাব্যতা সংকট অন্যতম। দখলদার উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের রায় আছে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের কারণে। কারণ, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে যারা এখানে আসেন তারা আন্তরিক না। তারা এখানে আসেন, আবার পদোন্নতি নিয়ে চলে যান। কর্ণফুলী মরে গেলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাই শুধু প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে না থেকে আমরা যারা চট্টগ্রামের তাদেরও আন্তরিক হতে হবে। এ নদী গবেষক বলেন, প্রাকৃতিক, রাসায়নিক ও বাস্তুতান্ত্রিকণ্ডএই তিন কারণে কোনো একটি নদী মারা যায়। বর্তমানে কর্ণফুলী নদী এই তিনটিতেই আক্রান্ত। বন্যা, খরা ও পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয় এবং বিভিন্ন শিল্পবর্জ্য বা অন্যান্য বর্জ্যের কারণে যখন নদী হুমকির মুখে পড়ে, সেটি হবে রাসায়নিক কারণ। এই দুইয়ের কারণে নদীতে যখন জলজ প্রাণী মারা যাবে তখন সেটি হবে বাস্তুতান্ত্রিক। শিল্পকারখানার বর্জ্যসহ অন্যান্য বর্জ্য তো নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছও বিলুপ্ত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দশ বছর পর কর্ণফুলী আরো পাল্টে যাবে। হারাবে ঐতিহ্য। কর্ণফুলী রক্ষার জন্য ইতোপূর্বে যে দখলদারদের তালিকা করা হয়েছিল তাদের উচ্ছেদের পাশাপাশি নতুন করে যেন আর কেউ দখল করতে না পারে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি মনে করেন, কর্ণফুলী নদীকে রক্ষায় একটি ‘আপডেট ল্যাবরেটরি’ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে সরকারি স্থাপনা থাকলে সেগুলোও উচ্ছেদের দাবি জানান তিনি

দখলদার উচ্ছেদ

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে ২ হাজার ১৮১ জন দখলদার বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে আরএস রেকর্ড মূলে কর্ণফুলী নদীর বাকলিয়া ও পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় সর্বমোট ২১১২ জন অবৈধ দখলদার এবং বিএস রেকর্ড মূলে বাকলিয়া, মাদারবাড়ি, গোসাইলডাঙ্গা, মনোহরখালি, ফিরিঙ্গিবাজার মৌজায় মোট ৬০ জন অবৈধ দখলদার আছেন। কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমিতে স্থাপনা গড়েছে। স্থানীয়ভাবে ১৫৮ একর ভূমির মূল্য দুই হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গছে, ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদী সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এই রিটের প্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী সংরক্ষণ এবং নদী দখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এই মর্মে রুল জারি করেছিলেন আদালত। এছাড়া নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার তালিকা আদালতে দাখিল করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ নির্দেশনার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়। আগ্রাবাদ সার্কেলের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবু হাসান সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটির প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর উচ্চ আদালতে দাখিল করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাই কোর্ট উভয় তীরের স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nineteen + 11 =