জরিমানা ফি বাতিলের দাবি : দ্বৈত ভর্তি বাতিলের নামে শিক্ষার্থীদের কাছে জাবি’র অযৌক্তিক জরিমানা দাবি

0
2887

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনার্স ও মাস্টার্স প্রোগ্রামে দ্বৈত ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড ইস্যুর জন্য অতিরিক্ত জরিমানা দাবি করছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ভর্তি বাতিল ছাড়া কোনোক্রমে একজন শিক্ষার্থী এক প্রতিষ্ঠানের কোন এক বিষয়ে ভর্তি থাকাকালীন অবস্থায় অন্য প্রতিষ্ঠানে কিংবা একই প্রতিষ্ঠানের অন্য কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়ার কথা নয়। এরপরেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী কী করে অন্য প্রতিষ্ঠানে কিংবা একই প্রতিষ্ঠানের অন্য কোর্সে ভর্তি হতে পেরেছে তার দায় নিতে না নিয়েই প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৭ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা আদায় করছে জাবি কর্তৃপক্ষ।

এদিকে অসংখ্য শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিলের আবেদন করে সব নিয়ম মেনে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে অন্য কলেজে ভর্তি হলেও কলেজগুলো তাদের ভর্তি বাতিলের আবেদন আমলে নেয়নি, ফলে সেই শিক্ষার্থীদেরও পুণরায় জরিমানা দিয়ে ভর্তি বাতিল করতে হচ্ছে। আর এতে করে চরম বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। তাদের পক্ষে এ জরিমানা দেওয়া সম্ভব নয়। সারা দেশে এরকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। যার মধ্যে রংপুর জেলার কারমাইকেল কলেজ, রংপুর সরকারি কলেজ ও বেগম রোকেয়া কলেজসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তভূক্ত সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শত শত শিক্ষার্থী রয়েছে। ভুক্তভোগী এ শিক্ষার্থীরা দ্বৈত ভর্তির জরিমানা ফি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির কার্যক্রম শুরু করে। সেই হিসেবে অনেকেই ভর্তি হয়ে যায়। পরে ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেলে ভর্তি বাতিলের আবেদন করে। তখন নির্দিষ্ট ফি আদায়ের মাধ্যমে ভর্তি বাতিলের পর তাকে তার মূল সনদ ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং সেগুলো জমা দিয়ে আবার নতুন প্রতিষ্ঠানে কিংবা একই প্রতিষ্ঠানের অন্য কোর্সে ভর্তি হতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও একই নিয়মে পূর্বের ভর্তি বাতিল করে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা একই প্রতিষ্ঠানের অন্য কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি বাতিল সাপেক্ষেই তারা মূল সনদ তুলে নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানে জমা দিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করেছে। কিন্তু ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার ৬/৭ মাস পরে হঠাৎ করে শিক্ষার্থীদের বলা হয় যে তাদের দ্বৈত ভর্তি রয়েছে। যা বাতিলের জন্য অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ১০ হাজার জরিমানা ও ৭০০ টাকা ভর্তি বাতিল ফি এবং মাস্টার্স এর শিক্ষার্থীদের ৭ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা ও ৭০০ টাকা ভর্তি বাতিল ফি দিতে হবে। অন্যথায় তাদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড ইস্যু করা হবে না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তভুক্ত রংপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম বর্ষের একাধিক শিক্ষার্থী বলেছেন, ২০১৬-১৭ সেশনে আমরা কলেজে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে ভর্তি হওয়ার পর এবার ভর্তি বাতিল করে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে ২০১৭-১৮ সেশনে অন্য বিষয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নতুন করে অন্য বিষয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিলে জরিমানার নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ভর্তি বাতিলকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিক পরিমাণে জরিমানা ধার্য করেছে। এ অযৌক্তিক জরিমানা পরিশোধ করা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা এই জরিমানা বাতিল করতে শিক্ষামন্ত্রীসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন কলেজের একাধিক শিক্ষক বলেছেন, বহু শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিলের আবেদন করে বিভিন্ন কলেজে কাঙ্খিত বিষয়ে ভর্তি হয়েছেন। অনেক কলেজে অনলাইন জটিলতার কারণে অথবা গাফিলতির কারণে ভর্তি বাতিল হয়নি। কিন্তু এ দায় কার? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করার সময় কেন তাদের অনুমতি দিল? তাদের এইচএসসির রোল নম্বর তো আগের বছর ভর্তির তালিকায় ছিল। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ওপর টাকার দায় চাপাচ্ছে কেন? আর জরিমানা যদি দিতেই হয় তা হতে পারত ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু ১০ হাজার টাকার মত এত বেশি জরিমানা কেন? তারা অভিযোগ করে বলেন, ভর্তি বাতিলের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা এবং পূর্ব কোনো নির্দেশনা না দিয়ে জরিমানা ফি আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে জাবি কর্তৃপক্ষ। মূলত টাকা হাতানোর জন্যই এই অভিনব ‘পন্থা’ আবিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। পড়াশোনা নয়, নানা ফন্দি-ফিকিরে অর্থ আদায়ই এ প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে, গত ২৮ মে সোমবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, কোনো শিক্ষার্থী যদি ইতোপূর্বে ভর্তিকৃত বিষয় বাতিল মর্মে কলেজের নিকট পূর্বে লিখিত আবেদন করে থাকে, সে সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট দাখিল করলে জরিমানার বিষয়টি পূণঃ বিবেচনা করে দেখা হবে। কিন্তু কবে থেকে এ কাজ শুরু হবে তার সময় উল্লেখ করা হয়নি।
এ ব্যাপারে রংপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ কানিজ উম্মে নাজমা নাসরিন বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো সভা না করে কিংবা কলেজগুলোকে পূর্ববর্তী কোনো প্রকার নোটিশ না দিয়ে হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় একইসঙ্গে শিক্ষক ও শির্ক্ষার্থী উভয়কেই ভোগান্তিতে ফেলেছে। রংপুরসহ সারা দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিপাকে পড়েছে। তিনি আরো বলেন, আমাদের কলেজে ৯৪ জন শিক্ষার্থীর দ্বৈত ভর্তির সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই শিক্ষার্থীদের জরিমানা ফি কমানোর জন্য আমরা তাদের তালিকা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছি।
প্রায় একই কথা বলেছেন সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের উপাধ্যক্ষ নুরুল আলম। তিনি বলেন, আমাদের কলেজে ৮১ জন শিক্ষার্থীর দ্বৈত ভর্তির সমস্যা দেখা দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তি জারি করার পর থেকেই আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করছেন না। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, এ কলেজে প্রায় ২৫০ শিক্ষার্থীর দ্বৈত ভর্তির সমস্যা দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে আছে যারা কলেজে আবেদন করে কিছু সময়ের জন্য তাদের মূল সনদপত্র উত্তোলন করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সেই সনদ দিয়ে অন্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু এখানে ভর্তি বাতিল করেনি। এ সকল শিক্ষার্থীদের দায় আমরা নিবো না। কিন্তু নিয়ম মেনে যারা ভর্তি বাতিল করার পরেও যাদের ভর্তি বাতিল হয়নি। তাদের তালিকা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক রবিউল হক বলেন, দ্বৈত ভর্তির কারণে শিক্ষার্থীদের জরিমানা করার বিষয়টি শুনেছি। কিন্তু এ বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য আলাদা ডিন রয়েছে। তারাই কলেজে ভর্তি ও ভর্তি বাতিলের বিষয়গুলো দেখেন। তিনি বলেন, রংপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তভূক্ত সরকারি-বেসরকারি প্রায় কলেজেই দ্বৈত ভর্তির সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ মে অনার্স এবং ১৭ মে মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের জরিমানা ও ভর্তি বাতিল ফি আদায়ের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করার বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twenty − 5 =