মোঃ আবদুল আলীম:
অগ্রণী ব্যাংক লি: রংপুর সার্কেলের নীফামারী শাখার মাধ্যমে শাওন অটো ব্রিক্স লি: এর নামে ভূয়া প্রকল্প দেখিয়ে যন্ত্রপাতি আমদানির নামে মার্কিন ডলার ১৫, ৫২, ৬১১ (বা: টা: ১২.১৭ কোটি) টাকা বিদেশে পাচারসহ ব্যাংকের প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে পোর্ট ডিমারেজ বাবদ সকারের রাজস্ব প্রায় ১১ কোটি টাকা ক্ষতিসহ মোট ৩১.২৩ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। অর্থ জালিয়াতির এই ঘটনার সাথে জড়িত মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মেসার্স শাওন ব্রিক্স এর ঋন ও অগ্রণী ব্যাংক এর যেসব কর্মকর্তাগণ উক্ত ঋনের নামে অর্থ লোপাটে জড়িত তার সকল কাগজপত্র, ডকুম্যান্ট ও স্টেটম্যান্ট এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
অগ্রণী ব্যাংক নীলফামারী শাখার অসাধু গ্রাহক প্রতিষ্ঠান শাওন অটো ব্রিক্স এর মালিক ও এমডি মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম (দানু) এবং ব্যাংকের কিছু অসাধূ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ঐ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মঞ্জুরীপত্র নং আইসিডি-১/শাওন অটো/৭৬৩/২০১৫ তারিখ ০২/১১/২০১৫ এর মাধ্যমে চীন থেকে যন্ত্রপাতি আমদানির নামে মার্কিন ডলার ১৫, ৫২, ৬১১ (বা: টা: ১২. ১৭ কোটি) টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ৩১/১২/১৭ ইং তারিখ পর্যন্ত অনারোপিত সুদ সহ ব্যাংকের পওনা ১৯.৪৭ কোটি টাকা যা মন্দজনক হিসেবে শ্রেণীকৃত এবং আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে অপরাধ বিচিত্রার পক্ষ থেকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড: জায়েদ বখত এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বোর্ড সভাকে এর জন্য দায়ী করেন। ব্যাংক সূত্রে জানা যায় চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে শাওন অটো ব্রিকস এর অনুকুলে ঋন পাস করিয়েছেন। এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে চেয়ারম্যান উক্ত ঋনের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেট থাকার কারনে বোর্ডের অন্য কেউ উক্ত ঋনের ব্যাপারে কোন প্রতিবাদ করতে পারেননি। কারন প্রতিবাদ করতে গেলে তার রোষানলে পরার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাংক সূত্রে আরও জানা গেছে আর্থিক খাতে এতবড় অনিয়মের মূল হোতা নিলফামারী জেলার ডোমার উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম (দানু), জিএম (প্রশাসন) মোঃ মশিউর আলী (বর্তমানে ডিএমডি হিসেবে পিআরএলরত), উক্ত শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মোঃ শফিকুল ইসলাম, রথিন্দ্রনাথ সরকার, রংপুর প্রধান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মোঃ মকবুল হোসেন, রংপুর সাবেক অঞ্চল প্রধান অর্জিত কুমার দাস ও মোঃ শহিদুল ইসলাম, রংপুর সার্কেলের জি এম মোঃ কামরুজ্জামান, কল্পনা সাহা, জি এম আইসিসি মোঃ মনোয়ার হোসেন এফসিএ ও আরও অন্যান্য কর্মকর্তা যারা ০১/১০/২০১৪ ইং হতে ২৩/০৮/২০১৬ ইং পর্যন্ত উক্ত অনিয়ম করেছেন। ব্যাংকের ২১/০৫/২০১৭ ইং, ২৬/১২/২০১৭ ইং এবং ২২/০১/২০১৮ ইং তারিখের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উক্ত দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি উদঘাটিত হয়েছে। ২১/০৫/২০১৭ ইং তারিখে শাখা প্রধান, রংপুর সার্কেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ডিভিশন-১ এবং আইটি এন এফসি এমডি ডিভিশন এর যৌথ পরিদর্শন প্রতিবেদনে যা উঠে আসে তা নিন্মরূপ:
১। মঞ্জুরীপত্রের শর্ত মোতাবেক স্থায়ী বরাদ্দকৃত ইকুইট/মার্জিন ও ঋনের পরিমান যথাক্রমে ৬.০৬ কোটি টাকা ও ১৫.০০ কোটি টাকা। মঞ্জুরী পত্রের শর্ত মোতাবেক ঋনগ্রহীতা ভবন ও পূর্তকাজ নির্মানে ২.১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পর ব্যাংক ঋনের ২.০০ কোটি টাকা ৬ টি কিস্তিতে বিতরনযোগ্য হবে। প্রথম কিস্তি বিতরনের পূর্বে ঋনগ্রহীতার ইকুইটি ২.১৫ কোটি টাকা নির্মান কাজে বিনিয়োগ নিশ্চিত হয়ে ১ম কিস্তি বিতরন করার পর শাখা, অঞ্চল, সার্কেল ও প্রধান কার্যালয়ের যৌথ পরিদর্শনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম এবং ৬ষ্ঠ কিস্তি বিতরনযোগ্য হবে। তবে ঋনগ্রহীতা তার ইকুইটি নির্মানকাজে বিনিয়োগ না করে পরস্পর যোগসাজসে ব্যাংক ঋনের ২.০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন যা ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উদঘাটিত হয়েছে।
২। মঞ্জুরী পত্রের শর্ত মোতাবেক স্থানীয় যন্ত্রপাতি বাবদ ঋন গ্রহীতার ইকুইটি ১.৭৪ কোটি টাকা এবং ব্যাংক ঋনের ২.০০ কাটি টাকা মোট ৩.৭৪ কোটি টাকা ৫ টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যথা (১) এডেক্স কপে লি: কে ১.৯০ কোটি টাকা, (২) সুমন ট্রেডার্সকে ৩.০০ লাখ টাকা (৩) এবারেষ্ট ফায়ার এলাইসকে ৫.০০ লাখ টাকা (৪) আগ্রাবাদ মটর লি: কে ১.৭৮ কোটি টাকা এবং (৫) ডিপ টউিবল মূল্য ২.০০ লাখ টাকা মোঃ শরিফুজ্জামান এর মাধ্যমে বসানোর কথা। কিন্তু ঋন গ্রহীতার ইকুইটির ১.৭৮ কোটি টাকা শাখায় জমা করা হয়নি এবং ব্যাংক ঋনের ২.০০ কোটি টাকার মাধ্যমে ভুয়া সরবরাহকারি সুমন ট্রেড লিংক এর নামে ১.৩০ কোটি টাকা ও ০.৭০ কোটি টাকা বিতরনের মাধ্যমে উক্ত টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অথচ স্থানীয় যন্ত্রপাতি অদ্যবধি সংগৃহিত হয়নি। স্থানীয় যন্ত্রপাতির সরবরাহ নিশ্চিয়তা না নিয়ে উক্ত টাকা নিয়ম বহির্ভুতভাবে বিতরন করে আত্মসাৎ করছেন। ১ টি ৩৫০ কেবিএ জেনারেটর ব্যতিত অন্যান্য স্থানীয় যন্ত্রপাতি প্রকল্পে অদ্যবধি সরবরাহ করা হয়নি যা ব্যাংকের ২১/০৫/২০১৭ ইং এবং ২৬/১২/২০১৭ ইং তারিখের প্রতিবেদন উদঘাটিত হয়েছে।
৩। মঞ্জুরীপত্রের শর্ত মোতাবেক ঋন গ্রহীতা আমদানীতব্য যন্ত্রপাতির জন্য ২.১৭ কোটি টাকা এবং ব্যাংক ঋনের ১০.০০ কোটি টাকা মোট ১২.১৭ কোটি টাকা মূল্যমানের যন্ত্রপাতি চীন হতে আমদানি করতে হবে। অর্থাৎ আমদানিতব্য যন্ত্রপাতির বিপরীতে ইকুইটি/মার্জিন মাত্র শতকরা ১৮। অথচ পরস্পর যোগসাজসে ৩০/১২/২০১৫ তারিখে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৪৪২ তম সভায় স্মারক নং ১৫৯৪/১৫ যা রংপুর সার্কেলের মঞ্জুরীপত্র নং মসরসা/ঋন/রং-৩৩৯ নীল-০২/১৬ তারিখ ২১/০১/২০১৬ এর মাধ্যমে উক্ত শর্ত শিথিল করা হয়। সে প্রেক্ষিতে এলসি খোলার সময় ঋন গ্রহিতা ৬১.০০ লাখ টাকা জমা করে মার্জিন অবশিষ্ট ১.৫৬ কোটি টাকার আগাম চেক ও ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প এ অঙ্গীকারনামা নিয়ে ডকুমেন্ট ছাড় করানোর সময় নেয়ার শর্তে এলসি খোলার অনুমতি প্রদান করার মাধ্যমে পরস্পর যোগসাজসে অর্থ আত্মসাৎ করায় সহযোগিতা করেছেন।
৪। ২৭/০১/২০১৬ ইং তারিখে রংপুর শাখার মাধ্যমে মার্কিন ডলার ১৫, ৫২, ৬১১ মূল্যমানের এলসি নং ০০২৮/ ১৬/০১/০০০৫ স্থাপন করা হয়। উক্ত এলসিতে ট্রেন্সশিপম্যান্ট, পার্টশিপম্যান্ট ইত্যাদি সকল সহজ শর্ত যুক্ত করে এবং এলসির মেয়াদ ২৩/০৪/২০১৬ ও সর্বশেষ জাহাজীকরনের তারিখ ০৬/০৭/২০১৬ ছিল যা মেয়াদ ১৮/০৭/২০১৬ তারিখ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। তাছাড়া এলসি খোলার পূর্বে আমদানীতব্য যন্ত্রপাতির মূল্য ও মান যাচাই করা হয়নি। ফলে ১ম দফায় ১১/০৬/২০১৬ ইং তরিখে মার্কিন ডলার ৫, ৩৭, ৬০০, ২য় দফায় ২১/০৭/২০১৬ তারিখে মার্কিন ডলার ৫, ০৮, ৭৯০ এবং ৩য় দফায় ১৩/০৮/২০১৬ ইং তারিখে মার্কিন ডলার ৫, ৩৭, ২১৯. ০০ মূল্যমানের যন্ত্রপাতি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে।
৫। ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায় ১ম দফায় মার্কিন ডলার ৫,৩৭, ৬০০.০০ মূল্যমানের মেশিনারিজ গ্রাহকের অবশিষ্ট মার্জিন/ইকুইটির ১.৫৬ কোটি টাকা জমা গ্রহন না করে বন্দর হতে অতিরিক্ত ১.৩১ কোটি টাকার পিএডি লোন সৃষ্টি করে ছাড় করান যা পরিদর্শনে দেখা যায় উক্ত মামাল পুরাতন, নিন্ম মানের ও অকেজ। ২য় ও ৩য় চালানের যথাক্রমে মার্কিন ডলার ৫.০৮,৭৯০.০০ এবং ৫,৩৭,২১৯.০০ মোট মার্কিন ডলার ১০, ৪৬, ০০৯. ০০ মূল্যমানের যন্ত্রপাতি যথাক্রমে ২১/০৭/২০১৬ এবং ১৩/০৮/২০১৬ ইং তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানো সত্যেও ফোর্স ডিমান্ড লোন সৃষ্টির মাধ্যমে ছাড় না করার কারনে ১৫/০২/২০১৮ তারিখ পর্যন্ত পোর্ট ডিমারেজ ও কন্টেনার ডেমারেজ বাবদ ১১, ৪৬, ৯৫, ০০৯.০০ টাকা গুনতে হচ্ছে যা প্রত্যেক দিন ১.৭৩ লাখ টাকা হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রংপুর সার্কেলের তদানিন্তন মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে জিএম আইন) দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন বলে জানা গেছে। তিনি উক্ত সার্কেলে ৬/১২/১৬ হতে ২৩/১/১৮ পর্যন্ত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর হতে মালামাল খালাসের কোন উদ্দোগ গ্রহণ করেননি এবং ঋন গ্রহিতার খেলাপি ঋন আদায়ে কোন ব্যবস্থা নেননি। সুকান্তি বিকাশ সারনাল বিষয়টি দীর্ঘ দিন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন এবং তিনি দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ঋন গ্রহীতার বিরুদ্ধে ঋন আদায়ের কার্যক্রম গ্রহণ না করে উল্টো শাওন ব্রিকস নামে ভুয়া প্রকল্পের অনুকুলে নতুন করে ৭ কোটি টাকা ঋন প্রস্তাব পাঠান বলে ব্যাংকটির অনেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন। কিন্তু ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটির হস্তক্ষেপে উক্ত ঋন প্রস্তাব বিবেচনায় না হওয়ায় ব্যাংকের উক্ত টাকা আত্মসাতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ ব্যাপাবে তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি প্রতিবারই মিটিং ও ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান। তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন তিনিই চেয়ারম্যান। অর্থাৎ চেয়ারম্যান যেন তার কথা ছাড়া নড়াচড়া করেন না। কাজে কর্মে চেয়ারম্যানের সাথে তার একটি অপকর্মের সম্পর্ক আছে বলে অনেকে মনে করেন। এ ব্যাপারে মোঃ মশিউর আলী (ডিএমডি) এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। গ্রহক মোঃ মনছুরুল ইসলাম (দানু) এর সাথে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ কররে তিনি সবই মিথ্যা ও ভুয়া বলে আর কোন কথা না বলে মুঠোফোন বন্ধ করে ফেলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হবে বলে সংশ্লিষ্টদের বিশ্বাস। মোঃ মনছুরুল ইসলাম দানুর মত একজন ঋন খেলাপি কিভাবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বহাল তবিয়তে থাকে তা নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। ঋন জালিয়াতি করে কিভাবে ব্যাংকটির কর্মকর্তাগণ বহাল তবিয়তে আছে তা তদন্ত করালে আরও অনেক ধরনের জালিয়াতির ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এ ব্যপারে এ প্রতিবেদকের তদন্ত অব্যহত আছে। আগামী সংখ্যায় চোখ রাখুন। (চলবে)