Site icon Aparadh Bichitra

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বেড়েই চলছে রাজধানীর বুকে

বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনায় তৃতীয় দিনের মতো শিক্ষার্থীরা গতকাল মঙ্গলবার রাজপথ প্রায় অচল করে দেয়। রবি ও সোমবার বিক্ষোভের পর শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের বার্তা দেয়, শিক্ষার্থীদের যেন বের হতে না দেওয়া হয়। এ কারণে গতকাল ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা আগের দুই দিনের মতো অবরোধে নামতে পারেনি।

তবে থামানো যায়নি রাজধানীর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের। ফার্মগেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর সনি সিনেমা হল, রামপুরা, নাবিস্কো, কাকরাইল, উত্তরা ও মতিঝিলসহ শহরের ১৫টি পয়েন্টে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ বাস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থীরা। শিশু-কিশোরদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে স্তব্ধ হয়ে যায় ব্যস্ত রাজধানীর রাজপথ। গতকালও জাবালে নূর পরিবহনের বাসচালকের শাস্তি, নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ক্ষমা প্রার্থনাসহ বাসচাপায় হত্যা প্রতিরোধে ৯ দফা দাবি তুলে ধরে তারা। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যায়। এই কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও যোগ দেয়। সকালে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি দুপুরে গাড়ি ভাঙচুর ও হামলায় গড়ায়। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ও উত্তরায় শিক্ষার্থীরা তিনটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাঙচুর করা হয় শতাধিক বাস। অবরোধের সময় বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট শুরু হয়। কোথাও যানজট, কোথাও সড়ক থেকে সব বাস উধাও—ফলে চরম দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। গতকাল সকাল ১০টার দিকে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী র‌্যাডিসন হোটেলের সামনের রাস্তার এক পাশে অবস্থান নিয়ে আধাঘণ্টা বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। ট্রাফিক পুলিশের উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল আলম জানান, তারা কিছু সময় থাকলেও বিমানবন্দর সড়ক বন্ধ হয়নি। এরই মধ্যে গতকাল সকালে ‘প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্স’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সড়ক অবরোধের আহ্বান জানানো হয়। সকাল পৌনে ১১টার দিকে ওই পেজ থেকে বলা হয়, ‘সবাই যার যার প্রতিষ্ঠানের (শিক্ষা) সামনের সকল রাস্তা বন্ধ করে দিন। অ্যাম্বুল্যান্স ও হজযাত্রী ছাড়া কোনো পিঁপড়ার বাহনও যেন না চলে। ’ রাজধানীতে গতকালও গণপরিবহন চলাচল ছিল সীমিত। ফলে বিভিন্ন স্থানে ছিল যাত্রীদের ভিড়। ছবিটি ফার্মগেট থেকে তোলা।

ফার্মগেটে অবরোধ : সকাল ১০টার দিকে তেজগাঁও কলেজ ও সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরা ফার্মগেটের বাবুল টাওয়ারের সামনের সড়ক অবরোধ করে। রাশেদ হাসান ও মার্টিন গোমেজ নামের দুই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, শিক্ষার্থীরা একটি বাস ভাঙচুর করে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা শাহবাগের দিকে রওনা হয়। তবে রূপসী বাংলা মোড়ে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। তাদের বিক্ষোভের কারণে প্রায় দেড় ঘণ্টা ফার্মগেট মোড় হয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া দেয়।

সায়েন্স ল্যাব মোড়ে আগুন : সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ধানমণ্ডির সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে ধানমণ্ডির আইডিয়াল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি, সিটি কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ও ঢাকা কলেজের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে সরানোর চেষ্টা করে। তখন উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা হিমাচল পরিবহনের একটি বাস ভাঙচুর করে এবং পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসসহ অন্তত ২০টি গাড়ি সেখানে ভাঙচুরের শিকার হয়। ধানমণ্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ জানান, দুপুর ২টার দিকে শিক্ষার্থীরা রাস্তা থেকে চলে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। তবে দুপুর আড়াইটার দিকে অবরোধ শেষে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থীর একটি দল নীলক্ষেত হয়ে লালবাগের দিকে যাওয়ার সময় মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট, বিকাশ পরিবহন, দেওয়ান, উইনার, ভিআইপিসহ বেশ কয়েকটি কম্পানির ২৫টি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় মৌমিতা ট্রান্সপোর্টের যাত্রী রহিমা খাতুন মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সন্তান যার মারা গেছে সে-ই কষ্ট বুঝে! তবে তাই বলে আরেক মায়ের রক্ত ঝরিয়ে কি বিচার পাওয়া যায়?’ লালবাগ থানার ওসি সুবাস কুমার পাল বলেন, ‘পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আমরা গতকাল রাতেই লালবাগের প্রায় সব কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছি। পুলিশ তৎপর ছিল বলে ঘটনা বেশি দূর এগোয়নি। ’ এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে জিগাতলায় জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুলিশের একটি রেকারে হামলা চালালে রেকার চালক দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে রাস্তার পাশে থাকা দুটি রিকশা এবং একজন মন্ত্রীর প্রটোকলের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। উত্তরা জসীমউদ্দীনে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। পরে শিক্ষার্থীরা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। উত্তরায় সংঘর্ষ, আগুন : দুপুর দেড়টার দিকে উত্তরার হাউস বিল্ডিংয়ে বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, মাইলস্টোন কলেজ, স্কলাসটিকাসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কয়েক শ শিক্ষার্থী ঢাকা-ময়নসিংহ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছাত্রদের বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ছাত্ররা পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেয়—বিকেল ৪টা পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করা হবে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মিছিল জসিম উদ্দিন রোড পর্যন্ত চলে যায়। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে জসিম উদ্দিন রোডে যানবাহন চলাচল করার অনুমতি দিলে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। র‌্যাব-১-এর কার্যালয়ের পাঁচ-সাত গজ উত্তরে অবরোধে আটকে পড়া টাঙ্গাইলগামী বুশরা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসে (টাঙ্গাইল-ব-১১-০০৪৭) ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও র‌্যাবকে লক্ষ্য করে পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ ও র‌্যাবের তাড়া খেয়ে শিক্ষার্থীরা গলির ভেতর চলে যায়। বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে এনা পরিবহনের একটি বাসেও (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৫৯৬২) আগুন ধরিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া হাউস বিল্ডিংয়ের সামনে পাঁচটি বাস ও একটি পিকআপ ভাঙচুর করে। পুলিশ লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাসেল সিকদার জানান, জসিম উদ্দিন রোডে এনা ও বুশরা পরিবহনের দুটি বাসে শিক্ষার্থীরা আগুন দেয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের দুটি টিম গেলেও শিক্ষার্থীরা তাদের বাধা দেয়। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। তাদের অভিভাবকদের ডাকা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মিরপুরে অবস্থান : সকাল ১১টার দিকে মিরপুরের সনি সিনেমা হলের সামনে মিরপুর কমার্স কলেজ ও মিরপুর বাঙলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা অবরোধে নেমে বেশ কিছু বাস ভাঙচুর করে। শিক্ষার্থীরা ১০ নম্বর থেকে আশপাশের রাস্তা বন্ধ করতে চাইলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। পুলিশের মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার সৈয়দ মামুন মোস্তফা বলেন, কমার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা যাওয়ার সময় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। দুপুর দেড়টার পর থেকে ওই এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। কাফরুল এলাকায় শহীদ স্মৃতি পুলিশ কলেজের শিক্ষার্থীরা দুপুরে রাস্তা অবরোধ করতে চাইলে তাদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে এক ছাত্র আহত হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শান্তিনগর এলাকায় বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে।

ব্রিজে আট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী : রামপুরা ব্রিজের ওপর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বনশ্রী শাখা, রামপুরা একরামুন্নেছা কলেজ, ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজ, বিএফ শাহীন কলেজ, তেজগাঁও মডেল কলেজ, গুলশান কমার্স কলেজ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য বোঝানোর চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা অনড় থাকে। এ ছাড়া তেজগাঁওয়ে নাবিস্কোর সামনে মানববন্ধন করে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ শুরু করে এবং দুটি বাসে ভাঙচুর চালায়। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ছাত্রদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। দুপুর ১২টার দিকে মতিঝিল শাপলা চত্বরের তিন দিকের সড়কের ওপর জড়ো হয়ে গাড়ি চলাচল থামিয়ে বিক্ষোভ করে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা।  রাজধানীর বিমানবন্দরের সামনের সড়কে গতকাল মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ ও নিহত সহপাঠীদের স্মরণ করে শিক্ষার্থীরা।    স্মরণে মোমবাতি : সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সোচ্চার শতাধিক শিক্ষার্থী গতকাল সন্ধ্যার পর মোমবাতি জ্বালিয়ে রাজীব ও মীমকে স্মরণ করে। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সামনে মোমবাতি জ্বালানো হয়। নিহতের সহপাঠীরা একই সঙ্গে ওই সময়ে সারা দেশে একযোগে মোমবাতি প্রজ্বালনের আহ্বান জানায়। জানা যায়, এতে সাড়াও মেলে অভূতপূর্ব। পুলিশের হামলায় আহত : মিরপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনায় আহাদ আলসান (১৯) নামে এক আহতকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আহাদের বাবা নুরে আলম বলেন, সে সকালে কলেজে যায়। কলেজর গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহাদ বাসার উদ্দেশে আসছিল। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের ধাওয়া লাঠিচার্জের সময় তার মাথায় ও পিঠে লাঠির আঘাত করে। পরে তার সহপাঠীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতাল নিয়ে যায়।