জনগণের কোটি কোটি টাকা মূলধন নিয়েছে কম্পানিটি

0
928

ব্যবসা সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়ে মূলধন তুলেছিল প্রকৌশল খাতের কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। নব্বইয়ের দশকে ড্রাইসেল ব্যাটারির কার্বন রড তৈরিতে প্রথমসারিতে থাকা কম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। ওই সময় ভালো চললেও কয়েক বছর ধরে সংকটে পড়েছে কম্পানিটি। কার্বন রডের চাহিদা কমে যাওয়ায় সিএনজি রিফুয়েলিং ও কেমিক্যাল প্যাকেজিং ব্যবসা শুরু করেছে কম্পানিটি।

ধারাবাহিক লোকসানের মুখে পড়া কম্পানিটি সর্বশেষ ২০১০ সালে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে। যদিও জনগণের কোটি কোটি টাকা মূলধন নিয়েছে কম্পানিটি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫টি কম্পানি লোকসানের মুখে। আর লোকসানে থাকা কম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশও দিতে পারেনি। তবে শুধু গত পাঁচ বছর শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি, এমন কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ। যার মধ্যে সরকারি শ্যামপুর ও জিলবাংলা সুগার মিলস দুই কম্পানিও রয়েছে। সরকারি এ কম্পানি কয়ের বছর ধরেই লোকসানে আর পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরেই শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিচ্ছে না। ২০১৫ সালের লিস্টিং রেগুলেশন আইনের ৫১(১)এ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ। আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কম্পানিকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। কম্পানির বর্তমান অবস্থা, উৎপাদন কিংবা লভ্যাংশ না দেওয়ার বিষয়ে সন্তোষজনক জবাব না পেলে তালিকাচ্যুত করার সিন্ধান্ত নেবে স্টক এক্সচেঞ্জ। এর আগে উৎপাদনে না থাকা দুই কম্পানিকে তালিকাচ্যুত করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ। তালিকাচ্যুতিতে জনগণের ২৩৩ কোটি টাকা না পাওয়ার অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সূত্র জানায়, লিস্টিং রেগুলেশন ২০১৫-এর ৫১ ধারা অনুযায়ী কম্পানিটিকে তালিকাচ্যুত করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ। এ আইনে বলা হয়েছে, পর পর পাঁচ বছর কোনো লভ্যাংশ না দেওয়া, তিন বছর বার্ষিক সভা করতে না পারা, মূলধন ঘাটতি কিংবা আদালতের আদেশে উৎপাদন বন্ধ, আইন লঙ্ঘন ও স্টক এক্সচেঞ্জের ফি তিন বছর না দিলে তালিকাচ্যুত করতে পারবে। এই লিস্টিং আইনের ৫১(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কম্পানির কোনো মতামত বা তাদের সুযোগ না দিয়ে তালিকাচ্যুতি করা যাবে না। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছর বা এর বেশি সময় ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়া ১৩ কম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার লক্ষ্যে কারণ দর্শানোর চিঠি দেবে স্টক এক্সচেঞ্জ। কম্পানির বর্তমান ও ভবিষ্যতের ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হবে। কম্পানির ব্যাখ্যা সন্তোষজন না হলে আইন অনুযায়ীই তালিকাচ্যুতির পথে এগোবে স্টক এক্সচেঞ্জ। গতকাল বুধবারও আরো দুই কম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইবে বলেও জানিয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ। জানা যায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কিন্তু লিস্টিং আইন যথাযথভাবে মানছে না, এমন ৩০ কম্পানি বাছাই করা হয়েছে। এসব কম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয় না, বার্ষিক সাধারণ সভাও (এজিএম) করতে ব্যর্থ। বছরের পর বছর লোকসানে রয়েছে। এসব কম্পানির মধ্যে শুধু পর পর পাঁচ বছর কোনো লভ্যাংশ দেয়নি, এমন কম্পানিকে কারণ দর্শাবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কম্পানির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবে স্টক এক্সচেঞ্জ। স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যানুযায়ী, পাঁচ বছর বা বেশি সময় ধরেই শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়া কম্পানিগুলোর মধ্যে আছে শ্যামপুর সুগার মিলস ও জিলবাংলা সুগার মিলস। পাট খাতের জুট স্কিপিনার্স লিমিটেড, ওষুধ ও রসায়ন খাতের ইমাম বাটন, বিবিধ খাতের সাভার রিফ্যাক্টরিজ, বস্ত্র খাতের দুলামিয়া কটন, ট্যানারি শিল্প খাতে সমতা লেদার কমপ্লেক্স, ব্যাংক খাতের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, সিরামিকস খাতের শাইনপুকুর সিরামিকস ও প্রকৌশল খাতের কে অ্যান্ড কিউ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। গতকাল বুধবার সোনারগাঁও টেক্সটাইল ও ইনফরমেশন সার্ভিস নেটওয়ার্কেও যুক্ত করা হয়েছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ কম্পানিগুলোর বেশির ভাগই পুরনো কম্পানি। শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় আশি ও নব্বইয়ের দশকে। কম্পানিগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একবিংশ শতাব্দীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন নতুন ধারায় পিছিয়ে পড়েছে কম্পানিগুলো। কোনো কম্পানি মূল ব্যবসা থেকে সরে অন্য ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়েছে। আবার কোনোটি পুরনোটিই আঁকড়ে ধরে রয়েছে কিন্তু লোকসান। স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারা বলছেন, আর্থিক হিসাব শেষে মুনাফা হলে বছর শেষে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেবে, এমন শর্তেই মূলধন উত্তোলনের সুযোগ পায় কম্পানি। মূলধন উত্তোলনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই জনগণের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে। কোনো লোকসানি কম্পানিকে মূলধন উত্তোলনের সুযোগ নেই। একটি কম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালোই থাকবে, এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। যেকোনো কারণেই অবস্থা মন্দা কিংবা খারাপ হতে পারে। বছরের পর বছর উৎপাদনে না থাকা কিংবা লোকসান করবে, এমন কম্পানি পুঁজিবাজারের জন্য খারাপ। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী থেকে বড় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নানা গুজব কিংবা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েও শেয়ার দাম হ্রাস-বৃদ্ধির কারসাজি ঘটে। মূলত পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারী স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একটি কম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হলে বিনিয়োগকারীর অর্থ পাওয়ার জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না, ক্ষতির মুখে পড়ে বিনিয়োগকারী। পর পর পাঁচ বছর লভ্যাংশ না দেওয়া ১৩ কম্পানিকে চিহ্নিত করে কারণ দর্শানোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীকে সচেতন ও একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী এসব কম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জ। লিস্টিং আইনে যথাযথ পরিপালন না হলে এসব কম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন  বলেন, ‘পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা আনার জন্য এর আগে আরো দুটি কম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী কিছু দায়িত্ব পালন না করলে তালিকাচ্যুত করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ। সেই আইন অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া হবে ১৩ কম্পানির বিরুদ্ধে, যারা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরেই কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এমন আরো কম্পানি আছে, যাদের অবস্থা ভালো নয়। সেই জন্যই চিহ্নিত করে বিনিয়োগকারীদের সতর্কবার্তা দেওয়া হলো যে এসব কম্পানিতে বিনিয়োগ নিরাপদ নয়। স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে চিঠি পাঠিয়ে কম্পানির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে। এই চিঠির মাধ্যমে বিনিয়োগকারী সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি কম্পানি সম্পর্কেও বিনিয়োগকারী জানতে পারল। সবাইকে চিঠি পাঠাব। সেটার অপেক্ষায় আছি। সন্তোষজনক উত্তর না পাইলে আইন অনুযায়ীই তালিকাচ্যুত করা হবে। আমরা চাই, একটা সুস্থ পুঁজিবাজার। কারণ দুর্বল বা লোকসানি কম্পানির বিষয়ে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে কারসাজির খেলা চলে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

six − two =