ঈদ সামনে রেখে কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা

0
988

খয়ের মিশিয়ে জংলি তারাগোটাকে বানানো হচ্ছে কালো এলাচ। জিরার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে মহুরি। পচন ঠেকাতে মরিচে মেশানো হচ্ছে আলফাটক্সিন নামের এক ধরনের ওষুধ। অন্যান্য মসলায়ও মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক। পানি মিশিয়ে মসলার ওজনও বাড়ানো হচ্ছে। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে বগুড়ার একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এ অপকর্ম করে মুনাফা লুটে নিচ্ছে।

কোটি কোটি টাকার মসলা মজুদ করে রাখা গুদামে মিলছে এ ভেজাল মসলা। বগুড়া ছাড়াও এসব মসলা পাঠানো হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে। বগুড়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ভেজাল মসলা বিক্রি, তৈরি ও গুদামজাত করে রাখার অভিযোগে একাধিক ব্যবসায়ীকে কারা ও অর্থদণ্ড দেন। এর পরও থেমে নেই নিম্নমানের, ভেজাল উপাদান মেশানো মসলা বিক্রি। অভিযান পরিচালনাকারী বগুড়া পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, মানবদেহে সাইপারমেথরিনের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএম হলেও বাজারে বেচা মসলায় পাওয়া গেছে গড়ে ০.৭৩ পিপিএম। ডায়াজিননের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএম হলেও বাজারজাত করা বিভিন্ন মসলায় পাওয়া গেছে ০.১৯ পিপিএম। বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলাম জানান, মানুষের শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে চলেছে মসলায় মেশানে এসব রাসায়নিক। এই মিশ্রণে হৃৎপিণ্ড, লিভার অকেজো হয়ে যায়। বগুড়া ৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহরের বাদুড়তলা এলাকার মসলা ব্যবসায়ী মেসার্স আলী এন্টারপ্রাইজের গুদামে জিরার সঙ্গে মহুরিজাতীয় মসলা ও বালু মিশিয়ে এবং জিরায় পানি মিশিয়ে ওজন বাড়িয়ে বাজারজাত করা হচ্ছিল। জিরায় নিম্নমানের বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে প্যাকেট করার অপরাধে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আলী আহম্মেদকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফতেহ আলী বাজারের মেসার্স এমআর স্টোরের গুদামে ভেজাল মসলা মজুদ করায় প্রতিষ্ঠানের মালিক মাহফুজুর রহমানকে ৬০ হাজার টাকা এবং আকাশতারা এলাকার আটা-ময়দা উৎপাদনকারী মেসার্স সুমন ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেডে ভেজাল পণ্য পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের মালিক রতন কুমার সিংহকে ৮৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল হাই সিদ্দিকী। বগুড়া পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শক শাহ আলী খান জানান, পৌরসভা এলাকায় মসলার বাজারে দাম বেড়েছে। কিছু ব্যবসায়ী জিরা, কালোজিরা, ধনিয়া, পাঁচফোড়ন, মহুরিতে চিকন বালু বা এক ধরনের পাউডার মিশিয়ে থাকে। এসব ভেজাল মসলা ভোক্তারা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ফতেহ আলী বাজারের ব্যবসায়ী আলী আহমেদের বাদুড়তলায় গুদাম আছে। তিনি গুদামে প্রতি কেজি জিরায় ৩০০ গ্রাম মহুরি মিশিয়ে প্যাকেট ও বাজারজাত করে আসছিলেন। বগুড়া বিএসটিআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে কিছু মসলায় ভেজাল বা নিম্নমানের কিছু উপাদান ব্যবহার করছে অসাধুচক্র। এমন সংবাদে আমাদের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’ বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, সম্প্রতি বগুড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত হওয়া কালো এলাচে খয়েরের প্রলেপযুক্ত জংলি গোটা মেশানো হচ্ছে। এটির আসল নাম তারাগোটা, যা মূলত সিলেটের মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলের বনে হয়ে থাকে। এটি সাধারণ এলাচের মতো দেখতে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কেমিক্যাল ও রং মিশিয়ে এগুলো কালো এলাচ বলে বাজারে চালিয়ে দিচ্ছে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাজারজাত হওয়া বিভিন্ন গুঁড়া মসলায় (মরিচ, হলুদ ও মিক্সড মসলা) মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের মিশ্রণ পাওয়া গেছে। পরিকল্পিতভাবেই এসব গুঁড়া মসলায় নিম্নমানের কাঁচামালের সঙ্গে ইট, কাঠ, ভুট্টা ও চালের গুঁড়া মেশানো হচ্ছে। এ ছাড়া স্বাদ, গন্ধ ও স্থায়িত্ব আনতে মানবদেহের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর রাসায়নিক ক্রোমাটেড, মেটানিল ইয়োলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে।বগুড়ার অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় মসলায় এ ভেজাল দিচ্ছে। এর আগে ফতেহ আলী বাজারের মসলার দোকান থেকে প্রায় ২০ বস্তা জংলি তারাগোটা, বেশ কয়েকটি জারিকেনবোঝাই কেমিক্যাল ও খয়ের উদ্ধার করা হয়। এই কেমিক্যালে খয়ের মিশিয়ে প্রতারকচক্র তারাগোটাকে কালো এলাচে রূপ দেয়। বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা বলছেন, মসলায় মেশানো ইট, কাঠ, ভুট্টা ও চালের গুঁড়া, ক্রোমাটেড, মেটানিল ইয়োলো, টেক্সটাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ বিভিন্ন কীটনাশক ফুটিয়ে রান্না করলেও এর বিষক্রিয়া নষ্ট হয় না। দীর্ঘদিন এসব মসলা গ্রহণে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মের আশঙ্কা থাকে। জানা গেছে, সঠিক পদ্ধতিতে মরিচ ধোয়া ও না শুকানোর কারণে গাছে ব্যবহার করা রিংডেন, ইউনালফস, এসিফেড, টায়োফজ, সাইপারমেথরিন, ডাইকোফল, ডায়াজিনন, স্যামকোজলসহ বিভিন্ন কীটনাশক শুকনা মরিচে থেকে যাচ্ছে। এসব কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব রান্নার পরও থেকে যায়। মসলা গবেষকরা জানান, দেশে বছরে মরিচের চাহিদা প্রায় দুই লাখ টন। চাহিদার অর্ধেকের বেশিটাই পূরণ হয় বগুড়ার গাবতলী ও সারিয়াকান্দির চরাঞ্চলের উৎপাদন থেকে। বগুড়া অঞ্চলে মাটির নিচ থেকে হলুদ (অপরিপুষ্টসহ) ওঠানোর পর সঠিক নিয়মে ঘাম ঝরানো, সিদ্ধ ও শুকানো হয় না। ফলে রং হারায় হলুদ। এই রং ফেরাতে ও ওজন বাড়াতে সিদ্ধ করার সময় তাতে মেশানো হয় বিষাক্ত রাসায়নিক ক্রোমাটেড। এ ছাড়া শুকানোর পর মেশানো হয় মেটানিল ইয়োলো, ফিটকিরি, টেক্সটাইল ডাই পিউরিসহ বিভিন্ন রাসায়নিক।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

eighteen − eight =