হাতে নগদ চার লাখ ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু এর পরেও বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না ফাতেমা বেগমের (৪২) যে এই টাকাগুলোর মালিক তিনি নিজেই। খুশিতে চোখের কোণে পানি জমেছে চট্টগ্রাম ইপিজেডের ইয়াং ইন্টারন্যাশনালের এই সিনিয়র সুইং অপারেটরের। পাশেই তাঁর সহকর্মী নাজমা, রীনা, শাহনাজ সবাই এই মুহূর্তে লাখপতি।
কোরবানির ঈদের ঠিক আগে আগে নিজেদের দীর্ঘদিনের প্রাপ্য টাকাগুলো হাতে পেয়ে সবার মুখেই খুশির ঝিলিক। দীর্ঘ প্রায় দুই বছর প্রতীক্ষার পর অবশেষে দুই হাজার ৭০০ শ্রমিকের ৩২ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ করেছে কোরিয়ান মালিকানাধীন ইয়াং ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার থেকে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ শুরু হয়ে শেষ হবে আজ সোমবার। এর মধ্যে ১৬ আগস্ট প্রথম দিনে ৭০০ শ্রমিকের ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। গতকাল রবিবার এক হাজার ২০০ শ্রমিকের ১২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। বাদবাকি ৮০০ শ্রমিকের ১০ কোটি টাকা আজ সোমবার পরিশোধ করা হবে বলে বেপজা সূত্র নিশ্চিত করেছে। এতগুলো টাকা একসঙ্গে পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে ফাতেমা বেগম সঙ্গে থাকা স্বামী ও ছেলের দিকে তাকালেন। মূলত টাকার নিরাপত্তার জন্য তাঁদের সঙ্গে এনেছেন। অনুভূতি সম্পর্কে বলেন, ‘গত সপ্তাহে যখন শুনলাম দীর্ঘদিন পরে হলেও আমাদের পাওনা পরিশোধ করা হবে তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ গত দুই বছরে এমন অন্তত ১০ বার শুনেছি। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, এবার সত্যি সত্যি আমাদের পরিশ্রমের টাকা পরিশোধ করা হবে। এই কারখানায় দীর্ঘ ২২ বছর চাকরি করেছি। হঠাৎ করে এমন ভালো একটা কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে এখন একসঙ্গে এতগুলো টাকা পেয়ে খুব ভালো লাগছে। এই টাকা দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু করব।’ তবে শ্রমিকদের টাকা পাওয়ার এই দীর্ঘ পথচলা খুব সহজ ছিল না। বরং পদে পদে শুধু হোঁচট খেতে হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেপজাকে। এমনকি শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে অসহযোগিতা করায় ইয়াং ইন্টারন্যাশনালের মালিক এইচ কে কোরের দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থিত বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে। সেখানে তাঁকে শ্রমিকদের পাওনা ও বাস্তবতা তুলে ধরে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। বেপজা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ইপিজেডে সাতটি প্লট নিয়ে ১৯৯৪ সালে একই বাউন্ডারিতে উইভিং, ডায়িং, সুইং ও ফিনিশিং নিয়ে একটি কম্পোজিট কারখানা গড়ে তুলে ইয়াং ইন্টারন্যাশনাল। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শ্রমিকের এই কারখানা থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরেও পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৩৪ কোটি টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে এইচএন্ডএম, ক্যারিফোর, প্রাইমার্ক, ড্রেসম্যান, ড্যাবো, সোনাই, টিচিবো, এলআইডিএলের বিখ্যাত বায়ারদের সঙ্গেই সুনামের সঙ্গে ২৮ বছর ব্যবসা করেছে কম্পানিটি। ইয়াং ইন্টারন্যাশনালের সব সমস্যার উৎপত্তি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি পরবর্তী অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কমপ্লাইয়েন্স ইস্যু নিয়ে। ডিইএ (ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট) নিয়ে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স প্রতিনিধি ব্যুরো বেরিতাসের নানা বায়নায় বিরক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক কো তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেন। এর পরেই তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এতেই অর্ডার নিয়ে সমস্যায় পড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এর আগে গত ২৮ বছর সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করেছে ইয়াং ইন্টারন্যাশনাল। এই দীর্ঘ সময়ে শ্রমিকদের এক মাসের টাকাও বাকি হয়নি বলে বেপজা সূত্র জানায়। কিন্তু কারখানাটি বন্ধ হওয়ার সময়ে কারখানায় কর্মরত দুই হাজার ৭০০ শ্রমিকের ভবিষ্য তহবিল (পিএফ), গ্র্যাচুইটিবাবদ প্রায় ৩২ কোটি টাকা আটকা পড়ে। পরে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ মালিক কো কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে বসে থাকেন। বেপজা নিজের উদ্যোগে একাধিক দেশি-বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও মালিকের অসহযোগিতার কারণে কোনো উদ্যোগও ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। ফলে মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়ে বেপজা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার আশ্রয় নেয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিলেটি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক এফসিআই (বিডি) লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ মতিন ইয়াং ইন্টারন্যাশনাল কিনে নেওয়ায় সমস্যাটি সুন্দর সমাধানের দিকেই এগিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর বলেন, ‘এফসিআইয়ের মতো নামি গ্রুপ কম্পানিটি কিনে নেওয়ায় দীর্ঘদিনের ইস্যুটির একটি সুন্দর সমাধান হয়েছে। ঈদের আগে আগে শ্রমিকরা পাওনা টাকাগুলো পেয়ে ভীষণ খুশি হয়েছে।’