বাসাবাড়িতে মাছ চাষ

0
1947

রাজিয়া সুলতানাঃ সেই কবে মজা করে কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার লিখেছিলেনÑ‘ডাঙায় চরে রুই-কাতলা!’ বিজ্ঞানের কল্যাণে এবার সত্যি সত্যি পুকুর, খাল-বিলের বদলে মাছের চাষ হচ্ছে ডাঙায়, একেবারে ঘরের ভেতর। অর্থাৎ পুকুর কেটে বড় আয়োজন করে মাছ চাষ, আর বহু রকমের ঝুট-ঝামেলা পোহানোর দিন শেষ। পেশাদার মনোভাব নিয়েই দেশে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে ইনডোর ফিশ ফার্মিং বা ঘরোয়া মাছ চাষ।
ঘরের ভেতরে শখের অ্যাকুরিয়ামে চোখ ধাঁধানো মাছ দেখেই এতদিন আমরা অভ্যস্থ ছিলাম। এবার চাইলে ঘরেই হবে মৎস্য চাষ। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিএসআইআর, সেন্টার ফর টেকনোলজির আওতায়-২০১৫ সালে নিয়ে এসেছে তেমন একটি প্রযুক্তি-নাম ইনডোর ফিশ ফার্মিং। প্রযুক্তিটি পূর্ব থেকেই চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খুব জনপ্রিয়। এই পদ্ধতিতে চাষ করা যায়-পাবদা, গুলশা, শিং, কৈ মাগুরসহ কার্প জাতীয় নানা মাছ। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছের পেশাদারি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সরকারি পর্যায়ের বাইরেও হাতে-কলমে চলছে বেসরকারি প্রকল্প। চাইলে আপনিও হতে পারেন এই প্রকল্পের একজন উদ্যোক্তা-মালিক। মাছের এই ঘরোয়া চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণে আপনাকে সার্বিক কারিগরি সহায়তা দেবে বাংলাদেশ শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)।

বিসিএসআইআর তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে ধাতব পাতের বড় এক কক্ষ তৈরি করে সেখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চালিয়ে যাচ্ছে মাছ চাষ। মোটা টিনের তৈরি ২ হাজার বর্গফুটের এই কক্ষটিতে ১১টি ট্যাংকে বিস্ময়কর দ্রুততায় বেড়ে উঠছে নানা প্রজাতির মাছ। এই পদ্ধতিতে প্রথম একটি বড় ঘরের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এরপর ঘরটিকে দুটি আন্তঃঘরে ভাগ করা হয়েছে। একটিতে থাকে পানির ট্যাংকি, যাতে থাকে মাছ আর অন্যটিতে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, যা পানিকে প্রতিনিয়ত রিসার্কুলেটেড সিস্টেমে পরিবর্তন করে। প্রতিটি ট্যাংকিতে পানি রয়েছে প্রায় ৩ হাজার লিটার। রয়েছে ৯ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২ ফেজের বিদ্যুৎ।
বিসিএসআইআর সূত্রে জানা গেছে-এই প্রকল্প কার্যকর করার জন্য কম-বেশি ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজন। আর প্রতিমাসে খরচ হবে প্রায় ২৫-৩০ হাজার। ২-৩ বছর পর হতেই লাভ আসা শুরু হবে। প্রকল্পটি নিরবচ্ছিন্নভাবেই চলবে প্রায় ৮-১০ বছর। এই পদ্ধতিতে জু প্লাংটন বা ফাইটোপ্লাংটন প্রয়োজন হয় না। দিতে হয় নির্দিষ্ট পুষ্টি উপাদান-সমৃদ্ধ ভাসমান ফিড। সিংকিং ফিড দেওয়া যাবে না। পরিমাণের চেয়ে বেশি ফিডও দেওয়া যাবে না। তা সিস্টেমের ওপর চাপ পড়ে। মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে অক্সিজেনের লেভেল রাখতে হয় ৮-এর ওপরে এবং এফসিআর অর্থাৎ ফিড কনভারশন অ্যান্ড পারফরমেন্স লেভেল রাখতে হবে ১.২। এতে ১ কেজি খাবার দিয়ে ১ কেজি ৪০০ গ্রাম মাছ পাওয়া সম্ভব। সাধারণভাবে পুকুরে ২ কেজি খাবার দিয়ে পাওয়া যায় ১ কেজি মাছ। পাবদা মাছের ক্ষেত্রে ইনডোর ফিশ ফার্মিং পদ্ধতিতে ১ কেজি মাছ উৎপাদনে খরচ পড়বে ১৮০ টাকা, যা কমপক্ষে বিক্রি হবে ৩০০ টাকা। বিজ্ঞানীদের দাবি, ওই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন হার প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ চাষের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি। ফলে লাভও হবে প্রায় ৩ গুণ বেশি। এই প্রযুক্তিতে ১ হাজার ঘনলিটার পানির ঘনত্বে ১০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে পুকুরে এই পরিমাণ পানিতে মাত্র ১০ থেকে ২০ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব। তাও যদি গ্রোথ প্রমোটর ব্যবহার করা হয়। বড় এক আয়োজন সামলাতে এখানে নামমাত্র শ্রমিক কাজ করছে। মাত্র দুজন শ্রমিক দিয়েই সমগ্র প্রক্রিয়াটা পরিচালনা সম্ভব। মাছ চাষে বিনিয়োগকারীদের লাভের নিশ্চয়তা প্রায় শতভাগ। কারণ মাছের মৃত্যুর হার ১ ভাগেরও কম। বড় ধরনের কোনো রোগবালাই নাই বললেই চলে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছ সুস্বাদু, এন্টিবায়োটিক ফ্রি ও রাসায়নিকমুক্ত। স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় এই মাছ ভোক্তাদের কাছে অধিক জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের অ্যাকুয়াকালচারের জনক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ারুল ইসলাম এক সেমিনারে বলেছেন, দেশে ইনডোর ফিশ ফার্মিং পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়েছে। এটা খুবই লাভজনক একটি প্রকল্প। কারণ অল্প জায়গায় অধিক উৎপাদন, কোনো ধরনের সংক্রমণ না হওয়া এবং শতভাগ নিরাপদ হওয়ায় বিশ্বে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়; বরং আধুনিক ও দেশীয় প্রযুক্তির সমন্বয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে ময়মনসিংহে এই প্রযুক্তিতে মৎস্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রাথমিক চর্চা চলছে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলেও। এই পদ্ধতিতে ক্যাটফিশ জাতীয় মাছের (পাবদা, গুলসা, শিং, মাগুর) চাষই বেশি ফলপ্রসূ হবে। ৮টি ট্যাংকে হচ্ছে পাবদা-গুলসা মাছের চাষ। ফিশ হ্যাচারি ও কালচার ফার্ম অ্যাগ্রো থ্রি নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই পদ্ধতিতে ৮টি ট্যাংকে ৮৫ হাজার পাবদা, গুলশা ও মাগুরের চাষ করছে। জানা গেছে-ওই দুই প্রতিষ্ঠানই চলতি বছর তাদের উৎপাদিত মাছ বাজারজাত করবে।
প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আগ্রহী উদ্যোক্তা-বিজ্ঞানীরা বিসিএসআইআর-র প্রকল্প পরিদর্শনে আসছেন। ক্রমে ক্রমে বাড়ছে এই প্রকল্পের প্রতি আগ্রহ। ফলে এই প্রকল্প হতে পারে মাছ চাষে বাংলাদেশের এক বিশাল অর্জনের স্মারক। কারণ গ্রামের পুকুর-ডোবা-খাল-বিলগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে কিছু মাছ উৎপাদন হয়। একসময় বছরের মাছের চাহিদা পূরণ হতো বাড়ির এসব উৎস থেকেই। এসব উৎসে প্রাকৃতিকভাবেই সারাবছর মাছের প্রজনন হতো। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে কমে গেছে পুকুর-খাল-বিল, নদী-নালা। ফলে মাছের চাহিদা পূরণের জন্য দেশে নানা উৎসে উৎপাদিত হচ্ছে হাজার হাজার টন মাছ। কৃত্রিমভাবে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ দারুণভাবেই সফল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাবিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ‘ইনডোর ফিশ ফার্মিং’ পদ্ধতি জনগণের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাংলাদেশকে হাজির করবে নতুন এক উচ্চতায়।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

10 − five =