মাছের দেশ বাংলাদেশ

0
1734

রাজিয়া সুলতানা:
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। রয়েছে প্রায় ৩১০টি বা কারও মতে ২৩০টি নদী, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে প্রায় ৬০০টি বাঁওড়, সিলেট বিভাগে রয়েছে অসংখ্য হাওড়। তাছাড়া আরও রয়েছে খাল-বিল, নালা, হ্রদ, পুকুর ইত্যাদি। এই বিশাল স্বাদু পানির এলাকাগুলো মৎস্য সম্পদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তা ছাড়া রয়েছে বিশাল সমুদ্র ভান্ডার। তাই আমরা আমাদের দেখতে পাই ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ সত্ত্বায়। মাছ নিয়ে এখন আর বাংলাদেশে হাহাকার নেই। মাছে পরিপূর্ণ সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ। এখন আর খাদ্য তালিকায় বিদেশি পণ্য হিসেবে মাছকে রাখা হয় না। বরং মাছ উৎপাদনে স্বয়ং সম্পন্ন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০২১-এ উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা (৪৫ লাখ মেট্রিক টন মাছ) অর্জনের জন্য মৎস্য অধিদফতরের আওতায় এবং ব্যক্তি উদ্যোক্তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে মৎস্য ভান্ডারে অর্জিত হচ্ছে দৃশ্যমান সাফল্য। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর বাংলাদেশ আজ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন।

মৎস্য খাত বর্তমানে দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জোগান দিচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, যা ছাড়িয়ে উৎপাদন হয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। বলা বাহুল্য মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা (৭১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন) ছাড়িয়েও উৎপাদন হয়েছে ৭১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদা অনুযায়ী মাছ ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করে সরকারের বছরে আয় করেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণে মৎস্য সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় আমিষের ৬০ শতাংশই আসে মাছ থেকে। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে পর মৎস্য খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান সরকার নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। যেমন আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ ব্যবস্থাপনা, অপ্রচলিত মৎস্য পণ্য উৎপাদন, বিল নার্সারি কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ, জাটকা সংরক্ষণ, ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষা, অভয় আশ্রম, মৎস্য সংরক্ষণ আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন, দরিদ্র জেলেদের আপদকালীন খাদ্য সহায়তা প্রদান ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ সকল কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের ফলে মৎস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি বেড়ে চলছে। এসব কাজের ফলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মূল্যায়নে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান এবং বদ্ধ জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদানে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। তাছাড়া সামুদ্রিক মাছ আহরণের দিক বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ের পর বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের মৎস্য আহরণ কয়েক গুণ বাড়বে। আগামী ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে ৪টি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। এরপরই আছে থাইল্যান্ড, ভারত ও চীনের নাম। মাছ উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় মিয়ানমারও এগিয়ে আসছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশের চাহিদা মেটাতে এখন মাছ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
আমাদের এ সাফল্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে নোনা ও মিষ্টি পানির ইলিশ ও চিংড়ি, অভয়াশ্রমের চিতল, ফলি, বামোস, কালিবাউস, আইড়, টেংরা, মেনি, রানি, সরপুটি, মধু পাবদা, রিটা ও গজার, চাষকৃত মাছের মধ্যে তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ, কমনকার্প, বিগহেড কার্প, থাইপুটি, মিররকার্প, চোষক মাছ, ব্লাক কার্প, থাই পাঙ্গাস, আফ্রিকান মাগুর, মিল্কফিশ, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, ভিয়েতনামের কই, থাই কই, আফ্রিকান মাগুর, রুই ও কাতল ইত্যাদি। তবে উৎপাদিত মাছের প্রায় ২০ শতাংশ আসে রুই-কাতলা থেকে। এছাড়া ১৬ শতাংশ পাঙাশ, ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ ইলিশ, প্রায় ১০ শতাংশ তেলাপিয়া থেকে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, গাজীপুর, বগুড়া ও কুমিল্লা জেলায় পুকুরে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘেরে মাছ চাষের ফলে এই অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশের মৎস্য খাত। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার ঘোষণার প্রধান লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য নিরসন। দরিদ্রতা হ্রাসের অন্যতম উপায় হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। মৎস্য খাত এ কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিশাল ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর এ খাতে প্রায় ৬ লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। গত ১০ বছরে প্রায় পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে দেশের ১১ শতাংশের অধিক বা প্রায় ১৭১ লাখ লোক তাদের জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য উপ-খাতের ওপর নির্ভরশীল। মৎস্য সেক্টরে সংশ্লিষ্ট এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ নারী, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ। এ ছাড়াও বিগত পাঁচ বছরে এই সেক্টরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অতিরিক্ত বার্ষিক ৬ লক্ষাধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিকের ৮০ শতাংশের অধিক নারী।
কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ইত্যাদির সাথে সাথে মৎস্য সম্পদের যে দিকটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এর পুষ্টিগুণ। মাছ মানুষের দেহের বিভিন্ন ভিটামিনের অভাব বিশেষত ভিটামিন-এ এবং ভিটামিন-ই মাছ থেকেই পূরণসহ অত্যাবশ্যকীয় খনিজ লবণের জোগান দেয়। দেশীয় ছোট মাছ শিশুদের অন্ধত্ব, রক্ত শূন্যতা, গলগন্ড প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা মাছকে সবচেয়ে নিরাপদ আমিষের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এতে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের সবগুলোই উপস্থিত। রয়েছে শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড। যা রক্ত চাপকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া রিউম্যাটয়েড, বাত রোগ বা অর্থাইটিস রোগ প্রতিরোধ করে। মাছের অপর নাম মস্তিস্ক খাদ্য। তাছাড়া শিশুদের হাঁপানি, মহিলাদের স্তন ও পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে মাছ। শরীরের বাড়তি ওজন কমাতে ও মেনপোজাল বা পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলাদের দেহ-মন ভালো রাখতে সাহায্যও করে মাছ। শিশুদের মস্তিস্কের বিকাশ ও চোখের উপকারীতার জন্য অসবৎরপধহ ঐবধৎঃ অংংড়পরধঃরড়হ সপ্তাহে কমপক্ষে দুবার মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মাছের ভিটামিন-এ চোখ ও ত্বকের জন্য উপকারী এবং রোগ ও বার্ধক্য প্রতিরোধক। তাহলে বলতে হয় আগামী পৃথিবী হওয়া উচিত সম্পূর্ণ মৎস্য সম্পদের অধীনে এবং মাছ হবে প্রধান খাদ্য। আর এ ধ্রুব সত্যকে উপলব্ধি করেই আমাদের মৎস্যপ্রেমী সরকার মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে আধুনিক তথ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও উদ্বুদ্ধকরণের নিমিত্তে উন্নত কলাকৌশল ও আধুনিক প্রযুক্তিবিষয়ক তথ্যাবলী বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে সরবরাহ ও সেবা প্রদান নিশ্চিত করছে। সমৃদ্ধ ও আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। তবে ফারাক্কা জাতীয় বাঁধের কারণে নদীর নাব্য, তৎসংলগ্ন হাওর-বাঁওড়-বিল ভরাট যাওয়া, কল-কারখানার বর্জ্যরে কারণে নদীর পানির দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। যা আমাদের মৎস্য সম্পদের জন্য ঝুঁকি দাঁড়াচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

6 + fifteen =