কালোবাজারি বিরাট এক সিন্ডিকেটের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে র‌্যাব

0
829

নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যশস্য খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) করার সরকারের কার্যক্রমের মধ্যে কালোবাজারি বিরাট এক সিন্ডিকেটের তথ্য উদ্ঘাটন করেছে র‌্যাব। খাদ্য অধিদপ্তরের তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় খাদ্যগুদামের (সিএসডি) কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ওএমএস ডিলার মিলে অন্তত ৪০ জন এই অপকর্মে জড়িত। সিএসডি ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবীর ও সিবিএ নেতা আলমগীর সৈকতসহ কয়েকজন চক্রের মূল হোতা।

খোলাবাজারে বিক্রির চাল ও আটা তাঁরা গোপনে সরিয়ে বাজারে বিক্রি করে আসছিলেন। কয়েক বছর ধরে এই অপকর্ম চলেছে, তবে গত দুই মাসে তা ব্যাপক জোরদার হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন ১৪১ ট্রাকে ওএমএস খাদ্যশস্য বিক্রির কথা থাকলেও বাস্তবে তা মাত্র ৩০টির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এতে দিনে প্রায় ৩৩৩ টন চাল ও আটা কালোবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এই হিসাবে দুই মাসে সিন্ডিকেট প্রায় চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে নিম্ন আয়ের মানুষের সুবিধার জন্য সরকার যে ভর্তুকি দিয়েছে সেই হিসাব যোগ করলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। গত শনিবার রাত থেকে রবিবার পর্যন্ত তেজগাঁও ও মোহাম্মদপুরে র‌্যাবের অভিযানে ২১৫ টন চাল ও আটা আটকের ঘটনার সূত্রে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আজ মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) কালোবাজারি সিন্ডিকেটের তথ্য-প্রমাণসহ একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে র‌্যাব। ওই প্রতিবেদনে এসব বর্ণনা থাকছে বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। এদিকে সরকারি চাল ও গম খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগে ১১ আড়তদারসহ অন্তত ১৯ জনের বিরুদ্ধে আজ মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করছে র‌্যাব। গতকাল রাত পর্যন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও মামলার প্রক্রিয়া চলছিল। অন্যদিকে গুদাম থেকে চাল ও আটা কালোবাজারে যাওয়ার ঘটনায় ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবীরকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। গত শনিবার রাতে সিএসডি থেকে পাচার হওয়ার সময় আটটি ট্রাকভর্তি ১১৫ টন চাল ও আটা জব্দ করে র‌্যাব। তাৎক্ষণিকভাবে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবীর এবং গুদাম ইনচার্জ মনিয়ার হোসেনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ২০ ঘণ্টা পর রবিবার রাত ৮টার দিকে মুচলেকা নিয়ে তাঁদের খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই দুই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ১১টি আড়ত থেকে ওএমএসের আরো ১০০ টন চাল ও আটা জব্দ করে র‌্যাব। এ ঘটনায় খাদ্য অধিদপ্তরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার তথ্য-প্রমাণ পেলেও প্রভাবশালী মহলের সুপারিশের কারণে হুমায়ুন কবীরকে ছেড়ে দেয় র‌্যাব। তবে অভিযুক্তদের আইনগত প্রক্রিয়া চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরিফুর রহমান অপু গত রাতে  জানিয়েছেন, ম্যানেজারের পদ থেকে হুমায়ুন কবীরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন যাঁকে দায়িত্বে দেওয়া হয়েছে তাঁকে আগামীকাল (আজ) কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে। সিএসডিতে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা নেই। আরো ক্যামেরা স্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন কর্মকর্তা সারওয়ার আলম  বলেন, প্রতিদিন একইসংখ্যক পয়েন্টে ১৪১ ট্রাক ওএমএসের চাল ও গম বিক্রি করার কথা। তবে অভিযানের আগে ও পরে তথ্য পাওয়া গেছে, ২৮ থেকে ৩০টির বেশি ট্রাক থাকছে না। অর্থাৎ বাকি ট্রাকের চাল-গম কালোবাজারি হচ্ছে। রাতেই এসব পণ্য খালাস হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালানোর পর অভিযানাটি চালানো হয়। তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস এই কালোবাজারি বেপরোয়া হারে চলছিল। সিএসডির খাদ্যগুদাম থেকে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এগুলো বাইরে যাচ্ছিল। সংশ্লিষ্ট সবাই এর ভাগবাটোয়ারা পাচ্ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মামলা করেছি। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মিলেছে তাদের ব্যাপারে প্রতিবেদন দিচ্ছি। বাকি তদন্তে প্রমাণিত হবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, র‌্যাব আজ মোহাম্মদপুর থানায় এ ব্যাপারে মামলা দায়ের করবে। এতে যাঁদের আসামি করা হচ্ছে তাঁদের মধ্যে ১২ জনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের বন্ধু রাইস এজেন্সির মালিক নজরুল ইসলাম, মেসার্স রাহমানিয়া রাইস এজেন্সির বিল্লাল হোসেন, কর্ণফুলী রাইস এজেন্সির গোলাম কিবরিয়া, মেসার্স জামি রাইস এজেন্সির ইকবাল হোসেন, সালেক এজেন্সির সালাউদ্দিন, এশিয়ান ট্রেডার্সের মিসকাতুর রহমান, সুগন্ধা রাইস ট্রেডিংয়ের গোলাম মোস্তফা, মহানগর ট্রেডার্সের তৈয়বুর রহমান, সুগন্ধা রাইস ট্রেডার্সের হাজি হান্নান, জননী এন্টারপ্রাইজের শাহ আলম, সূর্য এন্টারপ্রাইজের কবির হোসেন ও সিবিএ নেতা আলমগীর সৈকত।

ভেতরে-বাইরে কালোবাজারি সিন্ডিকেট

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তেজগাঁওয়ের খাদ্যগুদাম সিএসডির ব্যবস্থাপক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডিলার, আড়তদার, ঠিকাদার ও শ্রমিক নেতাসহ ৪০ জনের বেশি ব্যক্তি চাল-গম কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। রাতের আঁধারে সাধারণ মানুষের খাদ্যশস্য পাচার করে তাঁরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অনেকেই অল্প সময়ে হয়ে উঠেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। সূত্র জানায়, সিএসডি গুদামের ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবীরের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় ট্রাকে করে চাল-গম পাচার হয়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র সেখানে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তাদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রতি টন বাইরে বিক্রির জন্য এক হাজার টাকা করে নেন হুমায়ুন কবীরসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। গুদামের ইনচার্জ মনিয়ার হোসেন এ সিন্ডিকেটের অন্যতম। স্টক ইনচার্জ সুখরঞ্জন হালদার, ডিও শাখার ইনচার্জ কাজী মাহমুদুল হাসান ও গেট শাখার ইনচার্জ ইউনূছ আলী মণ্ডল এ কারবারের পুরো বিষয়টির সঙ্গে জড়িত। কর্মচারী হয়েও ভাগ বসান প্রধান নিরাপত্তারক্ষী হারেছ, নিরাপত্তাকর্মী বাবুল, ওজন পরিমাপক সুমন ও দুলাল, শ্রমিক নেতা (সিবিএ) আলমগীর সৈকত, দুদু মিয়া, লোকমান হোসেন ও বিল্লাল। আলমগীর গুদামে এই অপকর্মের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। সামান্য চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হলেও তিনি ব্যাপক দাপট নিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। র‌্যাব সূত্র জানায়, দুদকে দেওয়া প্রতিবেদনে আট কর্মকর্তাসহ অন্য কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তথ্য দেওয়া হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে বস্তা বদল করতেও দেখেছে র‌্যাবের দল। এই চক্র গুদামে খাদ্যশস্য রেখেও বিক্রি করে দেয়। সোহাগ নামে নারায়ণগঞ্জের একজন ডিলার দীর্ঘদিন ধরে এ কারবার করছেন। ১৪১টি ট্রাক আসা-যাওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে এর প্রমাণ মেলেনি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দিন ছাড়া রাতে খোলাবাজারে বিক্রির জন্য খাদ্যশস্য নিয়ে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে জব্দ করা ২১৫ টন রাতেই গুদাম থেকে বের হয়েছিল। মোহাম্মদপুরের ১১টি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ডিলার ও কর্মচারীদের প্রক্রিয়াকরণ কারবারের তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। এসব চক্র খোলাবাজারের চাল ফের মিলে পাঠিয়ে মিনিকেট হিসেবে তৈরি করে। এরপর সাধারণ ব্যাগে ভরে বিক্রি করে। একজন কর্মকর্তা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ট্রাকে তিন টন খাদ্যশস্য থাকার কথা। তবে অভিযানে জব্দ করা ট্রাকে পাঁচ থেকে আট টন খাদ্যশস্য পাওয়া গেছে।

যেভাবে সিন্ডিকেটের পকেট ভারী

অভিযানসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতি ট্রাকে এক টন চাল ও দুই টন গম থাকার কথা রয়েছে। সে হিসাবে ১১১ ট্রাক পণ্য যদি কালোবাজারে যায়, তাহলে দিনে ১১১ টন চাল এবং ২২২ টন গম কালোবাজারে বিক্রি হয়েছে। এই ৩৩৩ টন কালোবাজারির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নির্দিষ্ট হারে টাকা পেয়েছেন। একজন র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, সরকার ও জনগণের ক্ষতি করে এই চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতি টন চাল-গমের জন্য সিএসডি গুদামের ব্যবস্থাপকসহ কর্মকর্তাদের দিতে হয় এক হাজার টাকা। এ হিসাবে দিনে তিন লাখ ৩৩ হাজার টাকা পান তাঁরা। একইভাবে দুই মাসে তাঁরা (৫২ কর্মদিবস) এক কোটি ৭৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কর্মচারীরা নেন প্রতি টনে ৫০০ টাকা করে। সে হিসাবে দিনে এক লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা আদায় হয়। আর গত দুই মাসের আনুমানিক হিসাবে (৫২ কর্মদিবস) ৮৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা নিয়েছে সিবিএ সিন্ডিকেট। পুরো সিন্ডিকেট দুই মাসে ঘুষ নিয়েছে দুই কোটি ৫৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ‘ঘুষ জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেলেও বিষয়টি সরাসরি ধরা যায়নি। এরা সরকারি লোক। এদের সম্পদের হিসাব ধরে তদন্ত করলেই আরো সহজে প্রমাণ মিলবে। তাই আমাদের কাছে থাকা তথ্য-প্রমাণ দুদকে দিয়ে দিচ্ছি।’

সরকার ও গরিব মানুষের বিপুল ক্ষতি

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওএমএস কার্যক্রম সাধারণ মানুষের উপকারে আসায় সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। কিন্তু কুচক্রী মহলের অপতৎপরতায় এতে প্রত্যক্ষভাবে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতি কেজি চাল সরকার কিনেছে ৩৯ টাকা কেজি দরে। অথচ প্রতি কেজি চাল কালোবাজারে ৪০-৪৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। আর খোলাবাজারে ৯ টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করছে ৩০ টাকা দরে (২৮ টাকার সঙ্গে খরচসহ)। এক হাজার কেজিতে এক টন। এই হিসাবে ১১১ টনে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ৫২ দিনের কালোবাজারির হিসাবে সরকারের ক্ষতি হয়েছে পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। সূত্র জানায়, প্রতি কেজি আটা সরকার কেনে ৩২ টাকা দরে। ওএমএসে বিক্রি করা হয় ১৬ টাকা দরে। ভর্তুকি দেওয়া হয় প্রতি কেজিতে ১৬ টাকা। দিনে কালোবাজারি হওয়া ২২২ টন গমের জন্য সরকারের ভর্তুকি ছিল ৩৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা। দুই মাসের ৫২ দিনের হিসাবে এটি দাঁড়ায় ১৮ কোটি ৪৭ লাখ চার হাজার টাকা। এই হিসাবে চাল-গম মিলিয়ে সরকারের ভর্তুকির ২৩ কোটি ৬৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। গত দুই মাসের আনুমানিক এই হিসাব দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছে, কালোবাজারি চক্রের কারণে এইভাবে গত কয়েক বছরে সরকারের শত শত কোটি টাকা গচ্ছা গেছে।  জনকল্যাণে সরকারের মহতী উদ্যোগ থেকে সাধারণ মানুষও বঞ্চিত হয়েছে। এদিকে ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবীরের বক্তব্য জানতে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে রবিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গাড়িগুলো আমি লোড করি না। সিএসডি থেকে ট্রাকে করে খাদ্যপণ্য কিভাবে বের হলো, আমি বলতে পারব না।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 − 3 =