এ পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব শুধু জনমানবহীন এলাকায়

0
513

মেট্রো রেলের কাজ চলছে। ফলে এমনিতেই সড়ক গেছে সরু হয়ে। সেই সড়কটুকুও ভেঙেচুরে চলাচলের অনুপযোগী। রাজধানীতে চলমান মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজের বিষয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প নজরদারির দায়িত্বে থাকা আইএমইডি বলেছে, যে পদ্ধতি অনুসরণ করে মেট্রো রেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা শুধু জনমানবহীন এলাকায় করা সম্ভব।

ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ঠিক নয়। এই কাজের কারণে সড়কে প্রতিদিন যে অসহনীয় যানজট হচ্ছে এবং মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সে ব্যাপারেও অসন্তোষ জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে আইএমইডির একটি প্রতিনিধিদল প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কাছে পাঠিয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকায় একযোগে মেট্রো রেলের কাজ শুরু করায় ওই এলাকায় অসহনীয় যানজট তৈরি হচ্ছে। জানা গেছে, দেশের সব অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের জন্য বরাদ্দ রাখা নিয়ম হলেও মেট্রো রেল প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারে এক টাকাও রাখা হয়নি। এর ফলে মেট্রো রেল প্রকল্পের কারণে সড়কের যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা সংস্কার হচ্ছে না। উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যালয় এলাকা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো রেল প্রকল্পটির কাজ ২০২৪ সালে শেষ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ডিএমটিসিএলের। উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টর থেকে পল্লবী-রোকেয়া সরণি, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও হোটেল, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড হয়ে মেট্রো রেলের রুটটি মতিঝিল যাচ্ছে। কাজের ধরন নিয়ে আইএমইডি পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলেছে, মিরপুর এলাকাটি আবাসিক হওয়ায় প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ অফিস-আদালতে যাওয়ার পথে তীব্র যানজটের মুখে পড়ছে। যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এ ছাড়া মেট্রো রেল প্রকল্পের কারণে ধুলাবালিও বেড়েছে। এতে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। রাস্তাঘাটের অবস্থাও নাজুক। অনেক স্থানে খানাখন্দে ভরা। আইএমইডি বলছে, মেট্রো রেল প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য একটি স্বপ্নের প্রকল্প এবং এটি বাংলাদেশের প্রথম মেট্রো রেল প্রকল্প। তবে যানজট ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে প্রকল্প এলাকায় দিনে কাজ করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। রাতের বেলায় কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি। একই সঙ্গে এক  কিলোমিটার করে কাজ শেষ করে সামনে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষকে। জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব মফিজুল ইসলাম  বলেন, ‘ঢাকার যানজট কমাতে মেট্রো রেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এটি সরকারের একটি মেগা প্রকল্প। তবে এই প্রকল্পের কারণে যাতে তীব্র যানজট তৈরি না হয়, সেটিও দেখার বিষয়।’ আইএমইডির কর্মকর্তারা বলেছেন, দিনের বেলায় মেট্রো রেলের যানবাহন চলাচল, অ্যালাইনমেন্ট বরাবর মোট সড়কের মাঝে ১১ মিটার প্রশস্ততায় ব্যারিকেড দিয়ে পাইলিং ও পিয়ারের কাজ করায় মিরপুর সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে। এই যানজট কমাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে জনসাধারণের জন্য বিকল্প পথ ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা বলেছে আইএমইডি। এই লক্ষ্যে মেট্রো রেলের অ্যালাইনমেন্ট বরাবর রুট ব্যবহারের যথোপযুক্ত সময় নির্ধারণ এবং জনসচেতনতামূলক সাইন সিগন্যাল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ডিএমটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেছেন, মেট্রো রেলের কাজ দ্রুত মানুষের সামনে দৃশ্যমান করতে চায় সরকার। সে জন্য তাদের ওপর চাপ আছে যত দ্রুত সম্ভব কাজ করার। দ্রুত কাজ করতে গিয়ে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আইএমইডির প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মেট্রো রেল প্রকল্পের কারণে আগারগাঁও চার রাস্তার মোড়ে প্রতিদিন তীব্র যানজট তৈরি হচ্ছে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। অথচ এক বছর আগেও সেখানে তেমন যানজট ছিল না। সাঈদুল ইসলাম নামের একজন বাসযাত্রী  বলেন, দুই দিকের রাস্তা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। তার ওপর রাস্তা খানাখন্দে ভরা। সড়কের এক পাশ দিয়ে শুধু একটি বাস চলতে পারে। এসব কারণে প্রতিদিনই যানজট থাকে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আইএমইডির সুপারিশ মানা হচ্ছে না। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজ শেষ না করে নতুন করে ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেস ক্লাব এলাকায় কাজ শুরু করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা। আইএমইডি বলছে, ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কটি পুরো ঢাকা শহরের লাইফলাইন। এ অবস্থায় কন্ট্রাক্ট প্যাকেজ তিন ও চার-এর আদলে যদি একইভাবে পুরো অ্যালাইনমেন্টে একসঙ্গে কাজ শুরু হয়, তাহলে ঢাকায় যানজট প্রকট আকার ধারণ করবে। এ অবস্থায় কন্ট্রাক্ট প্যাকেজ পাঁচ ও ছয়-এর কাজ এক কিলোমিটার করে শেষ করে সামনে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি। এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে ‘মেনটেন্যান্স ডিউরিং কনস্ট্রাকশন’ নামের একটি খাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। উদ্দেশ্য থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হলে সংস্কার করে দেওয়ার। একই সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু মেট্রো রেল প্রকল্পে এই নামের কোনো খাত রাখা হয়নি। বরাদ্দ না থাকায় মেট্রো রেল প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার করা হচ্ছে না। সড়ক সংস্কার নিয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মেট্রো রেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলছে আলাপ-আলোচনা। কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মজুমদার  বলেন, ‘মেট্রো রেল প্রকল্পে সড়ক সংস্কারে টাকা আছে কি না তা আমার জানা নেই।’ এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে মেট্রো রেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন এবং ২০১৬ সালে রাজধানীর হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিলেও এখন পুরোদমে চলছে মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × 2 =