সুনামগঞ্জের পর্যটন এলাকা খ্যাত বারিক্যাটিলা (বড়গোপটিলা) কেটে বসতি নির্মাণসহ পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করা হচ্ছে। বন বিভাগ মামলা করেও পাহাড় রক্ষা করতে পারছে না। তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সীমান্ত নদী যাদুকাটার তীরে বাংলাদেশ অংশে একটি পাহাড়াকৃতির সুউচ্চ টিলা রয়েছে।
ঢালু ও খাড়া প্রকৃতির এই টিলা সরকারি নথিতে বড়গোপটিলা হিসেবে চিহ্নিত। এক দশক ধরে এটি বারিক্যাটিলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দৃষ্টিনন্দন এই টিলা পর্যটকদের কাছেও জনপ্রিয়। পাহাড় ও নদী সংশ্লিষ্ট গহিন বনের এই নৈসর্গিক টিলাটিতে প্রায় ৩১২ একর জমি রয়েছে; যার সবটুকু সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। এই টিলায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মিশনারি বিদ্যালয় এবং একটি গির্জাসহ মুসলিম ধর্মের মসজিদও রয়েছে। টিলার নিচে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকও রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের নিচে গত বছর টিলা কেটে পাঁচ থেকে সাতটি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। টিলার পশ্চিমাংশ কেটে বসতি স্থাপন করায় গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে টিলা ভেঙে বালু ও পাথরে রাস্তা ও ফসলি বোরো জমি ভরাট হয়ে গেছে। টিলা কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ বন্ধ না হলে পুরো টিলা ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে স্থানীয় লোকজনের আশঙ্কা। এদিকে উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত বছর টিলা কেটে বসতি স্থাপন করায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। বসতবাড়িগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরই আবার টিলা কেটে বসতি নির্মাণের হিড়িক পড়ে। সুনামগঞ্জ বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে টিলার পূর্ব-দক্ষিণের পাঁচ একর ভূমি সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। বিশ্বম্ভরপুর শক্তিয়ারখলা বন বিটের তত্ত্বাবধানে সামাজিক এই বনায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। উপকারভোগীরা আকাশমনি, আগর, গামারিসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষ লাগায়। তবে বন বিভাগের এই মূল্যবান বাগানে রয়েছে বড় বড় পাথর; যার ওপর দৃষ্টি পড়েছে পাথর ব্যবসায়ীদের। গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে টিলার পূর্বাংশের বনভূমি কেটে গাছপালা উজাড় করে পাথর উত্তোলনের উদ্যোগ নেয় স্থানীয় একটি চক্র। গাছ ও পাথর ব্যবসায়ী চক্রকে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। তিনি প্রতিবাদ করায় তাঁর ওপর হামলা করে দখলকারীরা। এ নিয়ে বনখেকো ও বনরক্ষকদের মধ্যে মারামারি ঘটে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর সরেজমিন পরিদর্শন করেন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. সেলিম মিয়া। তিনি গত ১৯ সেপ্টেম্বর তাহিরপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবরে সরেজমিন প্রতিবেদন জমা দেন। সরেজমিনে এসে লাল পতাকা টাঙিয়ে দখলবাজদের ওই ভূমিতে না যেতে নির্দেশ দেন। প্রতিবেদনে তিনি বন কাটার বিষয়টি উল্লেখ করলেও পশ্চিমাংশের টিলা কেটে বসতি নির্মাণের কথা এড়িয়ে যান। তাঁর প্রতিবেদনে টিলা কেটে পাথর ও গাছ বিক্রয়কারী এবং জবরদখলকারী হিসেবে বড়গোপ গ্রামের নূরুল ইসলাম, আব্দুল জলিল, বিল্লাল মিয়া, জাহিদ হাসান, সোলেমান, মো. হানিফা, মো. শফিকুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, মুছা মিয়া, আলমগীর, রাশিদ মিয়া, তোফাজ্জল, নিজাম মিয়া ও আদম আলীর নাম উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদনে তিনি অবৈধ ও বেআইনিভাবে পর্যটন টিলাটি কেটে পাথর উত্তোলন ও গাছগাছালি বিক্রি করায় পাহাড়ের সৌন্দর্য বিনষ্টের অভিযোগ এনেছেন। এ ছাড়া পর্যটকদের চলাফেরায় সমস্যা সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন। অবিলম্বে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে টিলার বন কেটে পাথর বিক্রি ও গাছগাছালি বিক্রির ঘটনায় বনায়ন কর্মসূচির সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান বাদী হয়ে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেছে চক্রটি। তা ছাড়া বন বিভাগও টিলা কেটে গাছ বিক্রির অভিযোগে একটি পৃথক মামলা করেছে। এদিকে পর্যটন এলাকার বনায়ন ধ্বংসকারী চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের বিচারের দাবিতে এলাকার কয়েক হাজার মানুষ গত শুক্রবার সকালে টিলার নিচে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। একই দিন চানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বন ও পাথর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এর পাশাপাশি বনায়ন প্রকল্পের সাধারণ সম্পাদকের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির সাধারণ সম্পাদক ও চানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বন বিভাগের বাগান কেটে গাছগাছালি বিক্রি ও টিলা কেটে পাথর উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর সশস্ত্র হামলা করেছে দখলদাররা। তারা আমার নামে হয়রানিমূলক মামলাও করেছে।’ ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমি সরেজমিনে গিয়ে গণ্যমান্যদের সঙ্গে কথা বলে বন বিভাগের বাগান কর্তনকারী ও টিলা কেটে পাথর উত্তোলনকারীদের তালিকা করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’ বিশ্বম্ভরপুর শক্তিয়ারখলা বন বিট কর্মকর্তা বীরেন্দ্র কিশোর রায় বলেন, ‘আমাদের বনায়ন প্রকল্প ধ্বংস করে যারা গাছপালা কর্তন করেছে এবং সাধারণ সম্পাদক প্রতিবাদ করায় তাঁকে মারধর করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’ সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘আমি শিগগিরই সরেজমিনে যাব। তা ছাড়া স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি দেখার জন্য বলব। পাহাড় ও বন ধ্বংস করে কোনো স্থাপনা করতে বা পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করতে দেওয়া হবে না।’