এসব কারখানার ধোঁয়ায় বৃদ্ধ ও শিশুদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না

0
785

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় সংরক্ষিত বনে কয়লা তৈরির অবৈধ ৩২টি চুল্লি গড়ে উঠেছে। এসব চুল্লিতে অবাধে শাল, গজারিসহ বিভিন্ন ধরনের কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া একটি পুরনো ব্যাটারি গলানোর কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব কারখানার ধোঁয়ায় বৃদ্ধ ও শিশুদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আজগানা, বাঁশতৈল ও গোড়াই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। আজগানা, তেলিনা, চিতেশ্বরী, গায়রাবেতিল, কুড়িপাড়া, খাটিয়ারহাট, মাটিয়াখোলা, ছিট মামুদপুর, রহিমপুর গ্রামের আটটি স্থানে চুল্লি তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া তরফপুর ইউনিয়নের ডৌহাতলী গ্রামে বনের ভেতর ৩০ শতাংশ জমির ওপর পুরনো ব্যাটারি গলিয়ে সিসা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। বন বিভাগের বাঁশতৈল রেঞ্জের বাঁশতৈল, কুড়িপাড়া, পাথরঘাটা ও হাঁটুভাঙ্গা বিট অফিসের আওতায় গ্রামগুলো অবস্থিত। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, একেকটি চুল্লি প্রায় ১২ ফুট গোলাকার ও ১৫ ফুট উঁচু। ইট ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি। চুল্লির আশপাশে স্তূপ করে কাঠ রাখা আছে। পাশেই রয়েছে বন বিভাগের গাছপালা। অদূরে আছে কিছু বসতঘর ও বাজার। চুল্লিগুলোর মালিক স্থানীয় ফরহাদ খান, মান্নান সরকার, আতোয়ার সরকার, ফজলুল হক, আব্দুর রশিদ, আমিনুল ইসলাম, আজিম, জাকির হোসেন, নোমান মিয়া, আব্দুল আজিজ, ইউনুস, মোন্নাফ মিয়া, মেছের আলী, মইজ উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন, রাসেল আহমেদ, নজরুল ইসলাম, ফরহাদ মিয়া, শরিফ মিয়া। এ ছাড়া গাইবান্ধার জয়নাল মিয়া পুরনো ব্যাটারি গলিয়ে সিসা তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন। খাটিয়ারাহাট এলাকার কারখানা শ্রমিক গায়রোবেতিল গ্রামের জগদীশ জানান, একটি কারখানায় কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানাতে ১৪ দিন সময় লাগে। প্রতিটি কারখানায় মাসে দুবার গড়ে ৮০ থেকে ৯০ মণ কাঠ পুড়িয়ে ৩০ কেজি ওজনের ৪০ বস্তা কয়লা তৈরি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়লা কারখানার কয়েকজন মালিক জানান, চিতেশ্বরী ও খাটিয়ারহাটে ১২টি এবং গায়রাবেতিল, আজাগানা ও মাটিয়াখোলাতে ১৬টি চুল্লি রয়েছে। এ ছাড়া ছিট মামুদপুর ও রহিমপুর এলাকায় আরো ছয়টি চুল্লি রয়েছে। এসব চুল্লিতে তৈরি করা প্রতি বস্তা কয়লা তারা ৬২০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে আজগানা ও আশপাশের বাজারে বিক্রি করেন। শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য মতে, এসব চুল্লিতে মাসে প্রায় তিন হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। চিতেশ্বরী গ্রামের নজরুল ইসলাম ও সুরুজ মিয়া জানান, চুল্লিগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এর ধোঁয়ায় শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্টসহ অনেকের নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। গাছপালায় ফল ধরলেও তা থাকছে না। কাঠ ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান ও কামাল হোসেন জানান, আগে ইটভাটায় কাঠ বিক্রি করা যেত। এখন সেখানে কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহার করে। ব্যাটারি গলানো কারখানার মালিক জয়নাল মিয়া বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছি। ডৌহাতলী গ্রামের হালিম মিয়ার ৩০ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়ে ব্যাটারি গলিয়ে সিসা তৈরি করছি।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি নিরুত্তর থাকেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) টাঙ্গাইলের ব্যবস্থাপক মীর জালাল আহমেদ বলেন, ‘বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো কারখানা গড়ে তোলা বেআইনি। কারখানাগুলোর কারণে জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন হচ্ছে। ধোঁয়া থেকে উৎপাদিত কার্বন এবং কার্বন মনোক্সাইড বাতাসের সঙ্গে মিশে হাইড্রো কার্বন তৈরি হচ্ছে, যা প্রতিবেশ (জীব অণুজীব) ব্যবস্থা (ইকো সিস্টেম) ধ্বংস করছে।’ তরফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইদ আনোয়ার হোসেনের মুঠোফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেন। ব্যাটারি পোড়ানোর জন্য দেওয়া ট্রেড লাইসেন্সের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘পরে কথা বলব’ বলে সংযোগ কেটে দেন। বন বিভাগের বাঁশতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, ‘গ্রামগুলো বাঁশতৈল রেঞ্জের আওতায় থাকলেও চুল্লিগুলো বন বিভাগের জায়গার বাইরে। কাঠ পোড়ানো ও ব্যাটারি গলানো হলেও বন বিভাগের কিছুই করার নেই। এ বিষয়টি দেখবে পরিবেশ অধিদপ্তর।’ পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলের উপপরিচালক মো. মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কাঠ পোড়ানো ও ব্যাটারি গলানোর বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

nine − 7 =