বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ, এ কারণে নতুন বিনিয়োগ থেকে এক রকম বিরত রয়েছে ব্যাংক

0
507

রাজধানীর শান্তিনগরে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখায় গ্রাহকদের আমানত জমা রয়েছে ৫৪০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই শাখা থেকে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৭০ কোটি টাকার মতো। শাখাটির ব্যবস্থাপক এ প্রতিবেদককে জানান, ঋণের চাহিদা তেমন নেই।

যে কারণে তহবিল থাকা সত্ত্বেও ঋণ বিতরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। টুকিটাকি যেসব ঋণ আবেদন জমা পড়ছে, তাও খুব একটা লাভজনক প্রকল্প নয়। কিছু আছে, যেগুলোতে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে নতুন বিনিয়োগ থেকে এক রকম বিরত রয়েছে তাঁর ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত আগস্টে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.৯৫ শতাংশ। এত কম প্রবৃদ্ধি গত আড়াই বছরে দেখা যায়নি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪.৮২ শতাংশ। অথচ চলতি বছরের শুরুতেও বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ শতাংশের কাছাকাছি। মূলত গত জানুয়ারি থেকেই দেশের ব্যাংক খাতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। নির্বাচনের বছরে ব্যাংকগুলোর ঋণে লাগাম টানতে গত জানুয়ারিতে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় থেকে ব্যাংক খাতে আমানত বাড়িয়ে এডিআর সমন্বয়ের প্রবণতা দেখা যায়। ফলে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমানতের সুদহার একটু একটু করে বাড়তে থাকে। অন্যদিকে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে। গত মার্চে এসে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) নেতারা তহবিল বাড়ানোর নানা উদ্যোগ নেন। গত জুনে বিএবি ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আমানতের সুদহার কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমতে শুরু করে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত আগস্টে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৯ লাখ ১০ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। এর আগের মাস জুলাইয়ে এর পরিমাণ ছিল ৯ লাখ সাত হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে ঋণের স্থিতি বেড়েছে দুই হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। অথচ গত ফেব্রুয়ারিতে এক মাসে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি বেড়েছিল ১০ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত জানুয়ারিতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল আট লাখ ৫১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি বেড়ে হয় আট লাখ ৬২ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। গত ফেব্রুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। ওই মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৮.৪৯ শতাংশ। গত মার্চে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭.৯৮ শতাংশ, এপ্রিলে ১৭.৬৫ শতাংশ, মে মাসে ১৭.৬০ শতাংশ, জুনে ১৬.৯৫ শতাংশ এবং জুলাই মাসে ছিল ১৫.৮৭ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোই একটু রক্ষণশীল ভঙ্গিতে এগোচ্ছে। তা ছাড়া এক অঙ্কের সুদে ঋণ দেওয়ার ঘোষণা থাকলেও সব ব্যাংক তা ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়ন করছে না। যে কারণে ব্যবসায়ীরা বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাচ্ছে না।’ এই ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, ‘দেশে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা থাকলেও স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। যে কারণে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ কিছুটা থমকে আছে।’ ব্যাংক খাত বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই, এমন দাবি সব সময়ই করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে গত দুই-তিন বছরে শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ ফের চালু হওয়ায় অবকাঠামো সুবিধার বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ী নিজেদের সুবিধার্থে অনেক কিছুই করে। অনেকে ব্যাংকের মালিক। অনেকেই ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর করে নিজেরা ঋণ নিয়ে চুপ করে বসে আছে। অন্য ব্যাংকগুলোর অনেকেই ৯ শতাংশ সুদ বাস্তবায়ন করেনি। ‘অন্যদিকে আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ কার্যকর করায় আমানতকারীরা ব্যাংকে আসছেন না। না এলে ব্যাংকগুলো ঋণ দেবে কিভাবে?’ বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হালিম চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের বছরে এমনিতেই ব্যাংকগুলো বাড়তি সতর্কতার সঙ্গে দেখেশুনে ঋণ দেয়। এর মধ্যে আবার এডিআর কমানোর পর থেকে ব্যাংক খাতে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। যেসব ব্যাংকের এডিআর নতুনভাবে নির্ধারিত সীমার ওপরে রয়েছে তারা কমানোর চাপে রয়েছে। তা ছাড়া সীমার মধ্যে থাকা ব্যাংকের এডিআর যেন না বাড়ে সে বিষয়ে সতর্কতার কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। তিনি আরো বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার ফল ভালো নয়। কেননা এর সঙ্গে শিল্প-প্রতিষ্ঠানের উত্পাদন ও কর্মসংস্থান জড়িত। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬.৮০ শতাংশ হতে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এ খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রারও নিচে নেমে এসেছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ওই বছরও নির্বাচনের আগে আগে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধস দেখা যায়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছিল ৯.৮০ শতাংশ, নভেম্বরে ছিল ৯.৪৮ শতাংশ এবং ডিসেম্বরে ছিল ১১.৫৭ শতাংশ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fourteen + 3 =