ব্রেক্সিটের কারণে দেশটিতে এখন মন্দাবস্থা চলছে চিংড়ি চাষ

0
808

খুলনা অঞ্চলে (খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা) চিংড়ি চাষের এলাকা কমছে। তাই স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন ও রপ্তানির পরিমাণও কমছে। একসময়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত চিংড়ির অবদান ফিকে হতে চলেছে।

চিংড়ি চাষি, ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগী, হিমায়িত কারখানার মালিক বা রপ্তানিকারক প্রভৃতি স্তরে দেখা যায় হতাশার সুর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রপ্তানি হওয়া গলদা চিংড়ির ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাজ্য। ব্রেক্সিটের কারণে দেশটিতে এখন মন্দাবস্থা চলছে। তাই চিংড়ির চাহিদাও কমে গেছে। তবে দেশে প্রতিবছরই গলদার উৎপাদন বাড়ছে। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) মতে, চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে চিংড়ি রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। বছরের শুরুতে চিংড়িঘেরে ভাইরাসজনিত কারণে চিংড়ি উৎপাদন মারাত্মক কমে যায়। এ ছাড়া অব্যাহত বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকা ও বরফ সংকটের কারণে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আবার চিংড়ির অভাবে কম্পানিগুলো সামর্থ্যের ১৫ থেকে ২০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারে না। ফলে বৈদ্যুতিক ব্যয়, ব্যাংক সুদ ও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে কম্পানিগুলো। আর এসবের বিরূপ প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে। ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের আনোয়ারা মত্স্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক গাজী মেহেদী হাসান বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে চিংড়িঘেরে রেণু পোনা ছেড়ে ভাইরাসের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। পরে আবারও নতুন করে পোনা ছাড়া হয়। কিন্তু বিক্রির সময় এলেই বাজার পড়ে যায়।’ তাঁর মতে, ‘গলদা চাষে খাবার বেশি লাগে, তাই খরচও বেশি। কিন্তু বিক্রি করে যদি উৎপাদন খরচই পাওয়া না যায়, তাহলে চাষিরা উৎপাদন থেকে সরে আসতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত।’ অন্যদিকে ছোট ব্যবসায়ীরা দাম কমে যাওয়ার জন্য রপ্তানিকারকদের দোষারোপ করেন। তাঁদের বক্তব্য, রপ্তানিকারকরা এক জোট হয়ে স্থানীয় বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কেনার ওপরই বাজার নির্ভর করে। তাঁরা দাম দিতে না চাইলে দাম পাওয়া যায় না। আবার তাঁরা চিংড়ি রপ্তানিকারক হিসেবে সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সুবিধা আদায় করেন। চিংড়ি রপ্তানিকারকদের মতে, ছোট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সত্য নয়। কারণ চিংড়ি রপ্তানি করতে পারলে দাম বেশি পেলে আমাদের লাভ। আমরা বিক্রি করতে পারছি না, দাম পাচ্ছি না; তাই বাজার হতে বেশি দামে চিংড়ি কিনতেও পারছি না। একাধিক রপ্তানিকারক জানান, বিদেশে চিংড়ির বাজার দখল করে আছে ‘ভেনামি’ নামের এক ধরনের হাইব্রিড চিংড়ি। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় এর ব্যাপক চাষ হয়। একরপ্রতি উৎপাদন ৮ থেকে ১০ হাজার কেজি। ততটা সুস্বাদু না হলেও পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহের কারণে সহজেই তা বাজার দখল করেছে। বিএফএফইএ এই প্রজাতির চিংড়ি চাষের অনুমতি দাবি করলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। খুলনা জেলা মত্স্য কর্মকর্তা শামীম হায়দার বলেন, ‘ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন অনেক বেশি হলেও এতে ভাইরাসজনিত ঝুঁকি থাকে। এ কারণে এই চিংড়ি আমাদের দেশে উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ।’ অবশ্য বিএফএফইএর সহসভাপতি শেখ আব্দুল্লাহ বাকী চিংড়ি উৎপাদনে আধুনিক পদ্ধতির ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “ইউরোপের বাজারগুলোতে ভারত চিংড়ি রপ্তানিতে ‘ট্যাক্স ফ্যাসিলিটি’ পায় না। এর পরও প্রতিযোগিতায় আমরা তাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। এর কারণ আমাদের চেয়ে তাদের চিংড়ি উৎপাদন প্রায় শতভাগ বেশি ও উৎপাদন ব্যয় অনেক কম। ব্যাংকগুলো চিংড়ি চাষে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে চাষিদের পক্ষে ভালোমানের পোনা সংগ্রহ করে উন্নত ব্যবস্থাপনায় চিংড়ি চাষ করা সম্ভব হবে।” খুলনা জেলা মত্স্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনাসহ দেশের উপকূলীয় জেলার প্রায় দুই লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রতিবছর বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়। চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। আর সারা দেশের মোট চিংড়িঘেরের ৮০ শতাংশই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়। দেশে মোট চিংড়ি উৎপাদিত হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন। বিদেশে চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খুলনাঞ্চল হতে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। তবে এর পরের বছর ২০১৬-১৭ বছরে উৎপাদন কমায় রপ্তানি কমে দাঁড়ায় ২৫ হাজার মেট্রিক টনে; গেল অর্থবছরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে ২২ হাজার মেট্রিক টন। অবশ্য ২০১৭ সালে চিংড়ি ও অন্যান্য হিমায়িত মাছ মোট রপ্তানি হয়েছে ৩৯ হাজার ৭০৬ মেট্রিক টন; যার অর্থমূল্য তিন হাজার ৬৮২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে একাধিক বিষয় উঠে এসেছে। তবে এর প্রধান কারণ, বিদেশের বাজারে চিংড়ির দাম কমে যাওয়া। এর পাশাপাশি অন্য কারণগুলো হলো, বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, চিংড়িতে নানা অপদ্রব্য মেশানোয় বিদেশের বাজারে সুনাম নষ্ট হওয়া, উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কম হওয়ায় মাঠপর্যায়ে চাষে অনীহা, আগের মতো নোনা পানির যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ কমে যাওয়া, ভাইরাসের সংক্রমণ, চিংড়ি চাষিরা ব্যাংকিং সুবিধা হতে বঞ্চিত হওয়া প্রভৃতি। খুলনা জেলা মত্স্য কর্মকর্তা মো. শামীম হায়দার জানান, বিশ্ববাজারে গলদার চাহিদা না থাকায় খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে রপ্তানিযোগ্য গলদা চিংড়ি। চাষের খরচ না ওঠায় তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। ব্রিটেনে গলদা চিংড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি ছিল। সেটা একদমই কমে গেছে। চাষি ও রপ্তানিকারকদের কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 + nineteen =