ফাংগাল ইনফেকশনের কারণে এই অবস্থা হচ্ছে

0
839

চিংড়ি খামারগুলোতে খাদ্য হিসেবে শামুকের মাংস বিক্রি হয়। এ কারণে বাগেরহাটের চিতলমারী, ফকিরহাট ও মোল্লাহাট উপজেলায় প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার বস্তা (প্রতি বস্তায় গড়ে দুই হাজার) শামুক বেচাকেনা হয়।

এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মাংস বিক্রির পর শামুকের খোলস থেকে চুন (পানের সঙ্গে চুষ্য) ও পোল্ট্রি ফিড (মুরগির খাদ্য) তৈরি হয়। বিল থেকে শামুক সংগ্রহ, ঘের মালিকদের কাছে পৌঁছানো, ভাঙা, খোসা সংগ্রহ, পুড়িয়ে চুন ও পোল্ট্রি ফিড তৈরি ও বাজারজাত কাজে নিয়োজিত হাজার হাজার মানুষ। শামুকের শক্ত খোলস ভেঙে ভেতরের মাংস চিংড়ি ও সাদা মাছের খাবার হিসেবে ঘেরে দেওয়া হচ্ছে। এতে মাছের ওজন ও শরীর দ্রুত বাড়ে। সম্প্রতি চিতলমারীর বিভিন্ন গ্রামের রাস্তা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় আট ইঞ্চি লম্বা কাঠের চটার মাথায় দেড়-দু ইঞ্চি লোহা পোঁতা। প্রতিটি জীবন্ত শামুকের পেছনের পেঁচানো অংশে লোহা দিয়ে পেটানোয় ব্যস্ত অসংখ্য মানুষের হাত। পেছনের অংশ ভাঙার পর কাঠের বাটওয়ালা ছোট ছুরি দিয়ে শামুকের মুখসহ নরম শরীর বের করে আনা হচ্ছে। রাস্তার ওপর কিংবা ঘেরপাড়ে বস্তায়, স্তূপাকারে রাখা শামুক ভাঙছে শিশু, নারী ও পুরুষরা। পাশের রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে যাচ্ছে ইঞ্জিন ভ্যান কিংবা পাওয়ারটিলারের ভটভটি। একটি দল ব্যস্ত বস্তাভর্তি কাঁচা শামুক বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের কাজে। আরেক দল ব্যস্ত আগের দিনের ভাঙা শামুকের দুর্গন্ধময় খোসা বস্তাভর্তি করে কারখানায় পৌঁছে দিতে। দুর্গন্ধময় গাড়ি দেখে পথযাত্রীরা নাক ঢাকছে। সরেজমিন আরো দেখা গেছে, চিতলমারীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে শামুকের খোলস সংগ্রহ করে এনে পুড়িয়ে অস্বাস্থ্যকরভাবে তৈরি হচ্ছে চুন। দুর্গাপুর গ্রামে শম্ভু সূত্রধরের রয়েছে শামুকের খোলস পোড়ানো কারখানা। অপরিচ্ছন্ন দুর্গন্ধযুক্ত খোলস মাসের পর মাস গাদা মেরে রেখে সারা বছর পোড়ানো হয়। দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়ায় দূষিত হয় এলাকা। ২০০৯ সাল থেকে চলছে এ কাজ। কারখানার আশপাশের বসতবাড়ির লোকেরা জানায়, দুর্গন্ধে প্রায়ই বাড়ির লোকেরা অসুস্থ থাকে। স্থানীয় সূত্র জানায়, চিতলমারী উপজেলার শিবপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম শামুকের খোলস থেকে পোল্ট্রি ফিড তৈরি করেন। তাঁর মোবাইল ফোনে কল করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বরিশাল থেকে আসা শম্ভু সূত্রধর জানান, তাঁর ট্রেড লাইসেন্স আছে। প্রতি কেজি চুন ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হয়। চুন যায় বরিশাল, ঝালকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। চুন তৈরির কারিগর নির্মল সূত্রধর জানান, চুল্লিতে একবারে ২০-২২ ‘ঢোপ’ শামুকের খোসা পোড়ানো হয়। প্রতি ঢোপে প্রায় পাঁচ হাজার শামুক থাকে। প্রতিবারে প্রায় চার শ কেজি চুন তৈরি হয়। চিতলমারীর শামুকের আড়তদার মো. শহর আলী শেখ জানান, মাদারীপুর, ঢাকার আশপাশ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও খুলনা থেকে পাইকারদের মাধ্যমে তিনি শামুক সংগ্রহ করেন। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যবসা চলে। চিতলমারী উপজেলার রায়গ্রামের চিন্তা হালদার (৪০) জানান, তিনি প্রায় ১৮ বছর ধরে শামুক ভাঙেন। তাঁর হাতের তালুতে অসংখ্য গুঁড়ি গুঁড়ি ছিদ্র হয়েছে, সেখান থেকে ঝরে কষ। ব্যথা করে। ব্যথার যন্ত্রণা বাড়ে রাতে। ব্যথা বুঝতে দেন না স্বামী, সন্তানদের। সরিষার তেল গরম করে হাতে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এ বিষয়ে চিতলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এটাকে অনেকে পেশাগত কারণে চর্মরোগ (কন্টাক ডারমাটাইটিস) বলে। সমাধান একটাই, শামুক ভাঙার পেশা ছেড়ে দিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে হাতে পচন ধরে গ্যাংগ্রিনের মতো ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে।’ বাগেরহাটের ডেপুটি সিভিল সার্জন পুলক দেবনাথ বলেন, ‘ধারণা করা যায় ফাংগাল ইনফেকশনের কারণে এই অবস্থা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলে রোগের সঠিক নাম নির্ণয় করা যাবে।’ বাগেরহাট সামাজিক বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা চিন্ময় মধু বলেন, ‘২০১২ সালের ১০ জুলাই সরকারি প্রজ্ঞাপনে শামুককে বন্য প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বন্য প্রাণী বিনষ্ট ও ধ্বংসের অপরাধে আইন অনুযায়ী এক বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তাই শামুক ধরা ও বাজারজাত করা সম্পূর্ণ অবৈধ।’ বাগেরহাট জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. এমদাদুল হক জানান, ‘কেউ অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’ চিতলমারী শেরে বাংলা ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘শামুক তৃণভোজী প্রাণী। পচা পাতাসহ মাটির পচন খেয়ে শামুক যে নির্যাস ত্যাগ করে তাতে পানি বিশুদ্ধ হয়, মাটির উর্বরাশক্তি বাড়ে। মাটি ও পানি ঠাণ্ডা রাখাসহ পরিবেশের ভারসাম্য ও ইকোসিস্টেম রক্ষার ক্ষেত্রে শামুকের রয়েছে অন্যতম ভূমিকা। শামুকের ডিম ইঁদুরে খায়, ফলে ইঁদুরের হাত থেকে ধান রক্ষা পায়।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

thirteen − eleven =