রাইস ব্র্যান অয়েল তৈরিতে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি এর সঙ্গে অন্য তেলও মিশিয়ে বাজারজাত করছে

0
723

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রাইস ব্র্যান অয়েল। গতানুগতিক ভোজ্য তেলের চেয়ে রাইস ব্র্যান সাশ্রয়ী ও স্বাস্থ্যকর, এমনটাই ভাবতে শুরু করেছে মানুষ। অথচ এতেও পাওয়া গেছে ভেজালের অস্তিত্ব।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পুষ্টি ইউনিট কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বাজারে থাকা রাইস ব্র্যান অয়েলের অন্তত ২৫ শতাংশের মধ্যে ভেজাল রয়েছে। রাইস ব্র্যান অয়েলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘গামা অরাইজনাল’ অনেক রাইস ব্র্যান অয়েলে পাওয়াই যায়নি। আবার কোনোটাতে পাওয়া গেলেও নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অনেক নিচে। কারণ হিসেবে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো রাইস ব্র্যান অয়েল তৈরিতে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি এর সঙ্গে অন্য তেলও মিশিয়ে বাজারজাত করছে। অন্যদিকে রাইস ব্র্যান অয়েল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের লেবেলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে গ্রাহকদের ঠকাচ্ছে বলেও ওই গবেষণায় উঠে এসেছে। রাইস ব্র্যান অয়েলের গুণগত মান পরীক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পুষ্টি ইউনিট গত মে মাস থেকে ‘কন্টামিনেশন অ্যান্ড অ্যাডাল্টেরাশন অব ফুড অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টস, প্রসেস, চেইন অ্যান্ড মলিফিকেশন’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছে। ওই গবেষণার আওতায় দেশের বাজারে পাওয়া সব রাইস ব্র্যান অয়েলের নমুনা সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি এসজিএস বাংলাদেশ কর্তৃক তেলের গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। ওই পরীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা শহর থেকে রাইস ব্র্যান অয়েলের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করাসহ রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, নিউ মার্কেট, বাসাবো, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, সাভার, উত্তরখান, টঙ্গী ও গাজীপুরের বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। সূত্র জানায়, ‘গামা অরাইজনাল’ একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা রক্তের  কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি প্লাটিলেট অ্যাগ্রিগ্রেশন ও রক্তের মাত্রাতিরিক্ত লিপিড কমায় এবং পেশির ভর বৃদ্ধি করে। এটি হার্টের জন্যও উপকারী। এ বিবেচনায় হার্টের রোগে ভুগছে—এমন অনেক রোগীর খাবার তৈরিতে রাইস ব্র্যান অয়েল ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি ১০০ মিলিগ্রামে এক মিলিগ্রাম অর্থাৎ সর্বনিম্ন ১ শতাংশ পর্যন্ত ‘গামা অরাইজনাল’ থাকার কথা থাকলেও পরীক্ষায় দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তেলে এর পরিমাণ ১ শতাংশের নিচে। আবার কোনোটিতে এর উপস্থিতি একেবারেই নেই। এ ছাড়া এসব তেলে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার ও ভেজাল মেশানোর প্রমাণও পাওয়া গেছে। এ কারণে ‘গামা অরাইজনাল’-এর সঠিক মাত্রা পাওয়া যায়নি। রাইস ব্র্যান অয়েল তৈরির সময় উপাদান ভালো না হলে, কুঁড়া থেকে দ্রুততার সঙ্গে তেল সংগ্রহ না করলে, সঠিক উপায়ে স্টোরেজ না করলে সেটি পরীক্ষা ছাড়াও ধরা পড়ে। এর স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যায়। বাজার থেকে সংগ্রহ করা নমুনাগুলো খালি চোখে ‘অর্গানোল্যাপটিক ক্যারেক্টার’ পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে প্রায় ৪০ শতাংশের মধ্যে দেখা গেছে, এগুলোর স্বাদ, বর্ণ ও গন্ধে পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ কম্পানিই তাদের পণ্যের লেবেলে সঠিক তথ্য প্রদান করছে না। অরাইজল/অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের ক্ষেত্রে সেম্পল-২-তে পরীক্ষা করে প্রতি লিটারে ১.৩ শতাংশ পাওয়া গেছে। কিন্তু পণ্যের লেবেলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ন্যাচারাল অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে ২৯.৪৪ মিলিগ্রাম/লিটার। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক (পুষ্টি) ড. মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা ২৫ শতাংশ রাইস ব্র্যান অয়েলে ভেজাল পেয়েছি। এই তেল তৈরিতে নিম্নমানের উপাদান ও অন্য তেল মেশানোর ফলে এই ভেজাল পাওয়া গেছে। অনেক ব্র্যান্ডের লেবেলে ভুল তথ্য দেওয়া রয়েছে। এগুলো কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই লেখা হয়েছে।’সূত্র জানায়, গুণগত মান বিচারে অন্যান্য ভোজ্য তেল থেকে রাইস ব্র্যান অয়েল কিছুটা আলাদা। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট; যেমন—গামা অরাইজনাল, ভিটামিন ‘ই’ (টোকোফেরল ও টোকোট্রাইনল), স্কোয়ালিনিন এবং কিছু পরিমাণে ফাইটোস্টেরল। ফলে গুণগত মান বিচারে অন্যান্য ভোজ্য তেল থেকে এ তেলের দাম কিছুটা বেশি হলেও তেলের ভিসকোসিটি কম হওয়ার কারণে তেল কম শোষিত হয় এবং রান্নায় পরিমাণে কম লাগে। রাইস ব্র্যান অয়েলে রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য রক্ষাকারী উপাদান। বাংলাদেশে মানুষের কাছে এই তেলের চাহিদা বৃদ্ধির মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তেলের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার উপযোগিতা, উচ্চ তাপমাত্রায় স্থিতিশীলতা, বিভিন্ন ফ্যাটি এসিডের স্বাস্থ্যকর সমন্বয় এবং সর্বোপরি ভালো স্বাদ ও গন্ধ। আমেরিকার হার্ট ফাউন্ডেশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে রাইস ব্র্যান অয়েল সিরাম কোলেস্টেরল কমাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। রাইস ব্র্যান অয়েলে বিদ্যমান উপকারী উপাদান রক্তে কোলেস্টেরলের শোষণ কমায় এবং দেহ থেকে তা বের করে দিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে রক্তের টিজির পরিমাণ কমায়। পাশাপাশি এইচডিএল কোলেস্টেরল/গুড কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়, যা হার্টের আর্টারিতে ব্লক জমতে দেয় না। ফলে হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপসহ আরো অনেক মারাত্মক সমস্যা কমায়। তবে গবেষকরা বলছেন, এর কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। রাইস ব্র্যান অয়েলে বিদ্যমান ওমেগা-৩-এর পরিমাণ ওমেগা-৬ থেকে অনেক কম। ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড প্রো-ইনফ্লামেটরি, অন্যদিকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড অ্যান্টি-ইনফামেটরি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে খাদ্যাভ্যাসে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের আনুপাতিক পরিমাণ ঠিক না থাকলে ইনফ্লামেশনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা পরে হার্টের সমস্যা, আর্থারাইটিস, ক্যান্সারসহ নানা স্নায়বিক রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। একই সঙ্গে একটানা রাইস ব্র্যান অয়েল না খাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। হোয়াইট গোল্ড, নিউট্রিলাইজ, মেট্রো, ধানি, ফরচুন, ইফাদ, স্বর্ণা, প্রাণ, সলিড গোল্ডসহ আরো কয়েকটি ব্র্যান্ডের রাইস ব্র্যান অয়েল দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। গত ১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানগুলো ২০ হাজার টনের বেশি রাইস ব্র্যান অয়েল উৎপাদন করে। এগুলো ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 − fourteen =