প্রবাসী লাশের আত্মকথা

0
531

একটানা ৭ বছর বিদেশ থেকে আজই দেশে পৌঁছাল মরদেহ। বিমানবন্দরে নামানোর পরই খুব যত্ন করে এসি নিয়ন্ত্রিত মাইক্রোবাসে করে আমাকে গ্রামের বাড়িতে আনা হলো। তখন প্রায়ই সন্ধ্যা। কান্না-কাটির ভিড় জমেনি।

 

ভাবলাম আমাকে বাড়িতে নিয়ে কাঁদবে। আগে থেকেই ভাই-বোন, বাবা-মাসহ গ্রামের অনেকেই আমাকে দেখার জন্য বাড়িতে বসে আছে। পাড়া-প্রতিবেশী, মাওলানাও এসে গেছেন। শুধু একজনের আসার বাকি। তার জন্যই সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে। বাহ! কয়েক বছর আগে বেকার বলে ঘৃণা করা মেয়েটাও আজ দেখি আমাকে দেখতে অধীর আগ্রহে বসে আছে। তার সঙ্গে কন্যা সন্তানও আছে। একদম আমার প্রেয়সীর মতই দেখতে। টানা টানা চোখ, তবে মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে আছে, মনে হয় ভয় পেয়ে এমন হয়েছে। চারদিকে হইচই অবস্থা। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, সবাই আমাকে নয় আমার সঙ্গে আসা কফিনের ভেতর কিছু একটা খুঁজছে। খুব আগ্রহ নিয়ে! ভাবছে হয়তোবা মরদেহের সঙ্গে মোটা অংকের কিছু একটা এসেছে। হায়রে মানুষ বড়ই নিষ্ঠুর। ছোট ভাইটা মনে মনে ভাবছে, যাক এবার ভাইয়ার সঙ্গে আসা বক্সের মধ্যে থাকা টাকাগুলো থেকে কিছু টাকা দিয়ে ভালো ব্যবসা শুরু করা যাবে! নয়তোবা টাকাগুলো কাজে লাগানো যাবে। মরদেহের তো কোন দাম নেই। যদি মূল্য থাকতো তাহলে আমাকে রেখে দিত। কবর দিতো না। আমার কষ্টের টাকা দিয়ে বিয়ে দেয়া বোনটাও ভাবছে, কীভাবে আমার সঙ্গে আসা টাকাগুলো থেকে কিছু টাকা দিয়ে স্বামীকে বিদেশ পাঠাতে পারবে। বা তাদের ঘর-বাড়ি দুই তলা থেকে পাঁচতলা হবে। কত চিন্তা আমাকে নয় টাকা নিয়ে। আর বাবা ভাবছে, ছেলেটা সারাটা জীবন পরিবারের শান্তির জন্য কষ্ট করে গেল। কিন্তু ঠিকমতো পরিবারটা গোছাতে পারলো না। কিছুই হলো না ছেলেটাকে দিয়ে। কি হতভাগা এক ছেলে। কপাল খারাপ হলে যা হয়। আর ঘরের একটা কোনায় বসে মা ভাবছে, কেউ খুলছে না কেনো এখনো কফিন বাক্সের ঢাকনাটা। কেউ দেখায় না কেন তাকে, আমার থেথলে যাওয়া চেহারাটা। শুধু মা আমার জন্য গুমরে গুমরে কাঁদছে। আর আমি নিজেকে নিজেই মরা হাতির মত ভাবছি। মরার পর নাকি হাতির মূল্য লাখ টাকা। সবার কাছে এখন আমারও দেখছি তেমনি অবস্থা, কখনো কোথাও মূল্য পাইনি। যখন বিদেশে ছিলাম তখন আমার নাম ছিল কামলা। দেশের মানুষও সম্মান দিত না। আজ পরিবারও দিলো না। যাক এখন আমি সব চাহিদা কিংবা দায়িত্বের বোঝা থেকে হাজার মাইল দূরে। এখন শুধু ঘুম হবে খুব শান্তির ঘুম।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one × three =