গ্যাস লাইন লিকেজ ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নিম্নমানের সিলিন্ডার ও অসচেতনতা প্রধান কারণ

0
759

গ্যাস লাইন লিকেজ ও সিলিন্ডার বিষ্ফোরণে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্নস্থানে এ সব দুর্ঘটনায় শিশু ও নারীসহ অকালেই ঝড়ে পড়ছে অনেক মানুষ।

 

যারা বেঁচে থাকেন তাদেরকে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। কখনোবা দুর্ঘটনায় পরে একটি পরিবারের সব সদস্যের করুণ মৃত্যু ঘটে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, মেয়াদুত্তীর্ণ ও নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহার, পুরনো গ্যাসলাইনগুলোর সংস্কার না করা এবং জনগণের অসচেতনতার কারণে এসব দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৩ অক্টোবার পর্যন্ত ঢাকায় প্রায় ১১৫টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে গ্যাস দুর্ঘটনায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ১০৩টি। এর মধ্যে গ্যাসলাইন লিকেজে ৫৫টি এবং এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে ৪৮টি। এ সব দুর্ঘনটায় ঘটনাস্থলেই মারা গেছে শিশুসহ ৬ জন এবং গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ৩১ জনকে। এর বাইরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো অনেকের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে, ২০১৫ সালে ৮০টি, ২০১৬ সালে ১৩১টি এবং ২০১৭ সালে প্রায় ৮৫টি সিলিন্ডার বিষ্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই গ্যাসের লিকেজ এবং এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকান্ড ও বিষ্ফোরণের ঘটনায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্যাসলাইন লিকেজ, গ্যাস সিলিন্ডার ও সিলিন্ডারের হোসপাইপ লিকেজ থেকে এ ধরনের অগ্নিকান্ড বেশি ঘটছে বলে ঢামেক সূত্র জানায়। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর আদাবর থানাধীন মোহম্মদীয়া হাউজিং এলাকায় গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিষ্ফোরণ ঘটে ৬ জন দগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধরা হলেন- বিল্লাল হোসেন (৩৫), নাইমা হক (৪৬), নাইম (৭), মুনায়েম (২৮), হোসনে আরা (৫৩) ও লাইলী (৩৫)। দগ্ধদের স্বজনরা জানায়, বাসার ছাদে গ্যাস লাইন মেরামতের সময় গ্যাস লিকেজ হয়ে বিকট শব্দে বিষ্ফোফরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। এত বাসার মালিক-ভাড়াটিয়াসহ এই ৬ জন দগ্ধ হয়। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ৬ নভেম্বর রায়েরবাগে গ্যাস লাইন লিকেজে বিষ্ফোরণ ঘটে রিয়াজ ও সোহেল নামে দুই টাইলস মিস্ত্রির মৃত্যু ঘটে। ২ নভেম্বর আশুলিয়া এলাকায় বিষ্ফোরণে একই পরিবারের ৫ জন দগ্ধ হন। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, গ্যাসের আগুন খুবই বিপজ্জনক। কারণ এটি মুহুর্তের মধ্যে পুরো ফ্লাটে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য দগ্ধ হয়। এই চিকিৎসক বলেন, গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে গ্যাস সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা অনেক বেশি বেড়ে যায়। রাজধানীতে শীত পুরোপুরি না পরলেও সম্প্রতি গ্যাসের আগুনে পোড়া রোগী হাসপাতালে বেশি আসছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের মতে, ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় ৪০ থেকে ৪৫ বছরের বেশি সময়ের পুরনো গ্যাস বিতরণ লাইন রয়েছে। এসব লাইনের সংস্কার ও তদারকির দায়িত্ব তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির থাকরেও দীর্ঘদিন ধরে এসব গ্যাস লাইনের সংস্কার ও তদারকি যথাযথভাবে হচ্ছে না। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত চুলার সাথে গ্যাসলাইনের সঠিক সংযোগ এবং এলপিজি সিলিন্ডারের সাথে চুলার ফিটিংস সঠিকভাবে না হওয়ায় অগ্নিকান্ড ও দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। এ সব বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, গ্যাসের দুর্ঘটনার জন্য নাগরিকরাও অনেকাংশে দায়ী। রান্না শেষে চুলা বন্ধ করা, আগুন জ্বালানোর আগে গ্যাসের উপস্থিতি জেনে নেওয়া এবং রান্না ঘরের জানালা খুলে রেখে আলো-বাতাশ প্রবেশের সুযোগ রাখলে এসব দুর্ঘটনা অনেকটা কমে যাবে। তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, অনেকে অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নিয়ে থাকে। এই লাইনগুলোতেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। একইভাবে পুরনো লাইনের যথাযথ তদারকি ও নিয়মিত সংস্কার না হওয়ার কারণে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে। এ সব কর্মকর্তারা আরও বলেন, তিতাসের ভোক্তা শ্রেণি অনেক বিশাল। যার কারণে চাইলে পুরনো সব লাইন একবারে সংস্কার ও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে গুরুত্ব বিভেচনা করে কাজ চলছে। এরপিজি সিলিন্ডার সরবরাহকারী সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ৬০টি কোম্পানির অনুমোদন থাকলেও ১৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করছে না। তাদের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার ৭২৮টি। আর দেশে তৈরি হয়েছে ১১ লাখ ৪ হাজার ৩৩৫টি সিলিন্ডার। এছাড়া গত ৫ বছরে বোতলজাত করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ সিলিন্ডার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে সিলিন্ডারের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান নেই। যারা মান নিয়ে কাজ করছে তাদেরও সঠিক সক্ষমতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিষ্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, সিলিন্ডারগুলো সাধারণত বিষ্ফোরিত হয় না। তবে সিলিন্ডারের রেগুলেটরের সঙ্গে চুলার সংযোগস্থলে ভালোভাবে ফিটিং না করার কারণে গ্যাস লিকেজ হয়ে পুরো বাসায় গ্যাস জমে থাকে। পরবর্তীতে রান্না করার সময় আগুন জ্বালাতে গেলে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিষ্ফোরণ ঘটে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 × three =