না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন

1
950

অবি ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলা চলচ্চিত্রের অনুরাগীদের কাছে ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমণি’, ‘দুই পয়সার আলতা’ বা ‘ভাত দে’ স্মৃতিকাতর নাম। দেশের চলচ্চিত্রের ধ্রুপদী নির্মাণের কথা বললে আসবে এ নামগুলোও। আর এর প্রত্যেকটির নির্মাতা আমজাদ হোসেন।

 

দেশের চলচ্চিত্রে নতুন ধারার সৃষ্টিকারী এ মানুষটি একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। বহুগুণী এ মানুষটি জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে তিনি ব্যাংককের বামরুনগ্রাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী ও পাঁচ ছেলে-মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

আমজাদ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীর কাছে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তুলে ধরা এ মানুষটির ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে ভূমিকা।

আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় ব্যাংককের পথে ছিলেন আমজাদ হোসেনের বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল। তিনি  বলেন, বাবা ২টা ৫৭ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্যাংককে পৌঁছানোর পরই মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

১৮ নভেম্বর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে আমজাদ হোসেনকে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তির কয়েকদিনের মাথায় তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমজাদ হোসেনের উন্নত চিকিৎসার খরচ বাবদ ২০ লাখ টাকা এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া বাবদ ২২ লাখ টাকা পরিবারের হাতে তুলে দেন তিনি। ২৭ নভেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে আমজাদ হোসেনকে নিয়ে যাওয়া হয় ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। শুক্রবার মৃত্যুর সময় তার শয্যাপাশে ছিলেন ছেলে সোহেল আরমান।

আমজাদ হোসেনের বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়ক ফারুক (আকবর হোসেন পাঠান)। আমজাদ হোসেন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমজাদ ভাইকে নিয়ে কী বলব! আমরা দু’জন এক আত্মা, এক মন, এক প্রাণ ছিলাম। আমজাদ ভাই অনেক বড় মনের একজন মানুষ ছিলেন, অনেক বড় মাপের একজন নির্মাতা। অপূর্ব সৃষ্টিশীল একজন মানুষ ছিলেন। দেশে তার মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের আদৌ জন্ম হবে কিনা সন্দেহ আছে।’

শুরুর কথা : আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট, জামালপুরে। শৈশবেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে সাহিত্য ও নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িত হন। মহিউদ্দিন পরিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রে আসেন আমজাদ হোসেন। এরপর মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

পরের ইতিহাস একেবারেই অন্যরকম। আমজাদ হোসেনের লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন (১৯৬৩) সালাহ উদ্দিন। এতে আমজাদ হোসেন নায়ক হিসেবে অভিনয় করেন। এরপর আমজাদ হোসেন জহির রায়হানের ইউনিটে কাজ শুরু করেন। অভিনয়ের সঙ্গে ‘বেহুলা’র সংলাপও লেখেন।

চলচ্চিত্র পরিচালনা : ১৯৬৭ সালে নুরুল হক বাচ্চুর সঙ্গে মিলে নির্মাণ করেন ‘আগুন নিয়ে খেলা’। সে বছরই ‘জুলেখা’ দিয়ে এককভাবে পরিচালনায় আসেন তিনি। ছবি মুক্তির হিসেবে আমজাদ হোসেন আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ৩০তম পরিচালক, (প্রথম ‘মুখ ও মুখোশ’ পরিচালক আবদুল জব্বার)। এরপর জহির রায়হান প্রযোজিত ও মোস্তফা মেহমুদ, রহিম নেওয়াজ ও নুরুল হক বাচ্চুর সঙ্গে পরিচালনা করেন ‘দুই ভাই’ ছবিটি।

১৯৬৯ সালে করাচি থেকে ফিরে জহির রায়হান আমজাদ হোসেনের সঙ্গে আবার যুক্ত হলেন এবং দুজনে মিলে নির্মাণ করেন কালজয়ী ঐতিহাসিক ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’।

স্বাধীনপরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে আমজাদ হোসেনের। একে একে তিনি নির্মাণ করেন-বাল্যবন্ধু, পিতাপুত্র, এই নিয়ে পৃথিবী, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, কসাই, জন্ম থেকে জ্বলছি, দুই পয়সার আলতা, সখিনার যুদ্ধ, ভাত দে, হীরামতি, প্রাণের মানুষ, সুন্দরী বধূ, কাল সকালে, গোলাপী এখন ঢাকায়, গোলাপী এখন বিলেতে নামের দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলো। তার নির্মিত ‘ভাত দে’ ছবিটি এক অসহায় দরিদ্র বাউল শিল্পীর মেয়ে জরির করুণ কাহিনীর সফল চিত্ররূপ। আমজাদ হোসেনের নির্মিত ‘দুই পয়সার আলতা’ ও ‘ভাত দে’ ছবির জন্য কিংবদন্তি নায়িকা শাবানা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নয়নমণি’ ছবিটিতে ফারুক-ববিতার প্রেম সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।

সাহিত্যকর্ম : লেখালেখির মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল তার সৃজনশীল জীবন। তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ পত্রিকায়। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, জীবনী, ইতিহাসসহ বিভিন্ন গ্রন্থ। এর মধ্যে উপন্যাস- ধ্রুপদী এখন ট্রেনে, দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভালোবাসা, আমি এবং কয়েকটি পোস্টার, রক্তের ডালপালা, ফুল বাতাসী, রাম রহিম; মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস-যুদ্ধে যাবো, উত্তরকাল, যুদ্ধযাত্রার রাত্রি; জীবনীগ্রন্থ- মওলানা ভাসানীর জীবন ও রাজনীতি, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবন ও রাজনীতি; কিশোর উপন্যাস-জন্মদিনের ক্যামেরা, যাদুর পায়রা, ভূতের রাণী হিমানী, সাত ভূতের রাজনীতি; গল্পগ্রন্থ-পরী নামা জোছনায় বৃষ্টি, কৃষ্ণলীলা উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া ছোটদের জন্য তিনি অসংখ্য ছড়া ও গল্প লিখেছেন। তিনি নকালবাড়ী কৃষক আন্দোলন, বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের মতো ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থও রচনা করেছেন। সাহিত্যের অবদানের জন্য তিনি ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গীতিকার : আমজাদ হোসেন অসংখ্য কালজয়ী গান লিখেছেন। ‘আছেন আমার মোক্তার, হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ, কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিলো না, চুল ধইরো না খোঁপা খুলে যাবে গো, একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, বাবা বলে গেলো আর কোনোদিন গান করো না, এমন তো প্রেম হয়সহ বহু গান তিনি লিখেছেন।

অভিনেতা ও নাটক নির্মাণ : আমজাদ হোসেন প্রথম জীবনে অভিনয় করেছেন। পরে চলচ্চিত্র পরিচালনায় মনোনিবেশ করলেও আবার অভিনয় করতে শুরু করেন একটা সময়ে। শুধু চলচ্চিত্রই নয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন গুণী নাট্যনির্মাতা ও অভিনেতা হিসেবেও আছে আমজাদ হোসেনের ছিলেন সমাদৃত। ’৮০-র দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঈদের নাটক বলতে ছিল আমজাদ হোসেনের লেখা, পরিচালনায় ও অভিনয়ে ‘জব্বার আলী’ নাটকটি। যা সেই সময়ে বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পায়। আমজাদ হোসেন নিজেই অভিনয় করেছেন জব্বার আলী চরিত্রে।

পুরস্কার : চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৯৩ সালে একুশে পদক পান। তার পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিটি ৪ দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক শাখায় (৯টি) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের রেকর্ড ধরে রেখেছিল। এরপর ‘ভাত দে’ ছবিটি ৯ শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ছয়টি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেছেন আমজাদ হোসেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seven − two =