ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকির প্রতারণার শীর্ষে প্রাণ কোম্পানী

0
924

মো: আহসানউল্লাহ হাসানঃ বাজারে ভেজাল পণ্যে সয়লাব প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ রাজস্ব ফাঁকির প্রতারণায়ও শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বীরদর্পে ব্যবসা চালিয়ে আসছে প্রান কোম্পানী। মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ সরকারেকে ভ্যাট প্রদানের নিয়ম থাকলেও রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে উৎপাদিত পন্যের হিসাব নিকাশে একটি বৃহত অংশ গোপন রেখে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে একাদিক সুত্র জানায়। একাধিক অভিযোগে ভিত্তিতে ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গুলোতে একযোগে অভিযান চালায় ভ্যাট গোয়েন্দা।

ভ্যাট ফাঁকির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কাগজপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করে তারা। বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ অনেক অজানা তথ্য। সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গঠিত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তে ভিত্তিতে প্রাণের সব প্রতিষ্ঠানে একযোগে অভিযান চালিয়ে কাগজপত্র ও কম্পিউটার জব্দ করা হয়। এ টাস্কফোর্স ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে কাজ করে থাকে। ভ্যাট গোয়েন্দার ৫টি টিম নাটোর, নরসিংদী ও প্রাণের হেড অফিসে অভিযানে অংশ নেয়। মধ্যরাত পর্যন্ত অভিযান চালানো হয়। অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করে ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক এএফএম আবদল্লাহ খান বলেন, টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়েছে। সব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে না পারলেঅভিযান অব্যাহত রাখা হবে। এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বক্তব্য জানতে জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি জানে না বলে দাবি করে। এছাড়া কোনো কর্মকর্তা আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রসঙ্গত, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রি প্রায় ৪০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। কাঁচামাল আমদানির তথ্য গোপন করাসহ অনুমোদন ছাড়া রফতানি দেখিয়ে ও অবৈধভাবে রেয়াত নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন যাবৎ ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনস্থ সিলেট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের নিরীক্ষায় এ চাঞ্চল্যকর ভ্যাট ফাঁকির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে যুগান্তর ও যমুনা টিভি তথ্যবহুল সংবাদ প্রকাশ করে। এরপর কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াসহ দ্রুত অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় ভ্যাট গোয়েন্দা। হবিগঞ্জের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে রয়েছে গ্রুপটির রংপুর মেটালের কারখানা। এখানে দুটি ইউনিটে বাইসাইকেল, টায়ার, রিম, স্পোক, ক্যাবলওয়্যার, এমএস পাইপ, জিআই পাইপ ও টিউব তৈরি করা হয়। এর মধ্যে একটি ইউনিটের বন্ড লাইসেন্স নেয়া আছে। অন্য ইউনিটের বন্ড লাইসেন্স নেই। অথচ দুটি ইউনিট পণ্য উৎপাদনে একই কাঁচামাল ব্যবহার করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ইউনিট দুটোর আলাদা ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর (বিআইএন) থাকলেও আয়কর অফিসে ইউনিট দুটোর টিআইএন একটিই, যা কোনোভাবে হওয়ার সুযোগ নেই। সমজাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী দুটি ইউনিট পাশাপাশি হওয়ায় রাজস্ব ফাঁকির যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। জানা যায়, নিরীক্ষার জন্য তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে রংপুর মেটালকে ৯ বার চিঠি দেয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটি তদন্ত দলকে কোনো সহযোগিতা করেনি। পরে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড (কাস্টমসের ডাটাবেজ সফটওয়্যার) হতে আমদানি তথ্য, কর অঞ্চল-৬ চিঠির মাধ্যমে বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ও আয়কর রিটার্ন হতে তথ্যের মাধ্যমে নিরীক্ষা করা হয়। এতে যে পরিমান উৎপাদনের হিসাব উল্লেখ করা হয় তার চাইতে ৪গুন হিসাব গোপন রাখা হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হবিগঞ্জে রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রির দুটি ইউনিট প্রায় ৪০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। কাঁচামাল আমদানির তথ্য গোপন করে, রফতানির অনুমোদন ছাড়া রফতানি দেখিয়ে ও অবৈধভাবে রেয়াত নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১২ কোটি ৯৯ লাখ টাকার ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২২৯ কোটি ২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে। এ দুই অর্থবছরে ২৪২ কোটি ২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি দেখিয়ে মূসক-১৯ চালানের মাধ্যমে ৩৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার ভ্যাট দেয়। কিন্তু সিলেট ভ্যাট কমিশনারেটের নিরীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যেমন ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি দেখানো হয়। কিন্তু অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের তথ্যে দেখা যায়, প্রায় ৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানিটি প্রায় মূল্য ২১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার কাঁচামাল আমদানি কম দেখিয়েছে। এ কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পর তা বিক্রি করা হয়। এ হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। একই কায়দায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা অবৈধ রেয়াত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন পণ্য বা সেবা ক্রয়ের বিপরীতে কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এতে প্রায় উৎসে মূসক ১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সুদসহ মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৪ টাকা। সব মিলিয়ে ইউনিট-২ বিভিন্ন খাত সুদসহ ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হেড অফিস ও কারখানায় একযোগে অভিযান চালায় ভ্যাট গোয়েন্দা টিম। প্রাথমিকভাবে ভ্যাট ফাঁকির হিসাব প্রমাণিত হওয়ায় অধিকতর তদন্তের জন্য ১১টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। বর্তমানে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান আছে। প্রসঙ্গত, প্রাণ-আরএফএলের নিন্মমানের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী এবং তাদের নানামুখী অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও জনহয়রানির বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হয়েছে তার সপক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষিত আছে। কিন্তু প্রতিটি ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায় না। তারা উৎপাদনসহ কারখানার পুরো পরিবেশ দেখানোর জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে গণমাধ্যমকে নিয়ে যেতে চান। অথচ সংবাদের প্রয়োজনে আকস্মিক পরিদর্শন করতে চাইলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় না। এখানেই লুকিয়ে আছে সব রহস্য। সবকিছু জেনেও প্রশাসনও নিশ্চুপ থাকে কেন? এই প্রশ্নের একটি উত্তর সবারই জানা আছে। তবে অবাক করার মতো আরো একটি উত্তর জানা অপেক্ষায় আমাদের সাথে থাকুন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 − 9 =