বাংলাদেশের শিল্পীরা কলকাতা মাতালেন

0
718

দক্ষিণ কলকাতার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্র সরোবর। সুবিশাল এলাকা নিয়ে কৃত্রিম লেকের পাশে দাঁড়িয়ে এ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আর এ কেন্দ্রের মধ্যমণি নজরুল মঞ্চ।

 

গতকাল শনিবার বিকালে নজরুল মঞ্চ প্রাঙ্গণে ঢুকতেই দেখা গেল তাক লাগানো দৃশ্য। কলকাতার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গণের মানুষের পদচারণে মুখর গোটা এলাকা। সেখানে তৈরি করা হয়েছে যেন মিনি বাংলাদেশ। চারদিকে নানা স্টল। ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্টলসহ নানা রকমারি পণ্যের মেলা। নজরুল মঞ্চ মিলনায়তনে ঢুকতেই শোনা গেল বাংলাদেশের শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা। কখনো পঞ্চকবির সুরসূধা, কখনোবা আধুনিক গানের মায়াবী সুরের ঝরণাধারায় সিক্ত হলো কলকাতার দর্শকশ্রোতারা। ফাঁকে ফাঁকে পরিবেশিত হলো লোকসঙ্গীত, পুরনো দিনের বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্রের গান। পাশাপাশি মিলনায়তন ভরা দর্শকশ্রোতাদের মাতালেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল চিরকুট। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার নজরুল মঞ্চে আয়োজিত দুই দেশের শতাধিক শিল্পীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত ‘বাংলা উৎসব’ হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত ও জমজমাট। উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল শনিবার। দুপুর থেকে রাত অব্দি বাংলাদেশের শিল্পীরা নানা ধারার বাংলা গান পরিবেশন করে মুগ্ধতা ছড়ান কলকাতার শ্রোতামহলে। শুধু বাংলাদেশের শিল্পী নন, উৎসবে রর্ণিল সুরসুধায় রঙিন করেন কলকাতার শিল্পীরাও। দুই দেশের বাংলা গানের উৎকর্ষ ও বিকাশের প্রত্যয়ে বাংলা উৎসবের আয়োজক যৌথভাবে বাংলাদেশের বেঙ্গল গ্রুপ ও কলকাতার বন্ধন ব্যাংক। সহযোগিতায় রয়েছে কলকাতার বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ এবং নাথিং বিয়ন্ড সিনেমা। পৌষের রোদমাখা দুপুরে গতকাল শুরু হয় উৎসবের দ্বিতীয় দিনের আনুষ্ঠানিকতা। প্রথম পর্বে গানে গানে মুগ্ধতা ছড়ান বাংলাদেশ ও ভারতের নবীন শিল্পীরা। প্রথমেই মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের তরুণ শিল্পী মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য ও ডলি মন্ডল। পরে পর্যায়ক্রমে গান পরিবেশন করেন কলকাতার শিল্পী আকাশ ভট্টাচার্য ও অঙ্কিতা বসু। ভরাট কণ্ঠে তরুণ শিল্পী তূর্য গেয়ে শোনান ‘যেতে যেতে একলা পথে’, ও ধীরে ধীরে প্রাণে আমার’ শিরোনামের দুটি গান। চার তরুণের পরিবেশনা শেষে বিকালে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। তাতে বাংলাদেশের শিল্পীরা একচেটিয়াভাবে গান গেয়ে মুগ্ধ ও অভিভূত করেন কলকাতার শ্রোতাদের। লাইসা আহমদ লিসা, ইফ্ফাত আরা দেওয়ান, খায়রুল আনাম শাকিল, অদিতি মহসিন, বুলবুল ইসলাম, চন্দনা মজুমদার গানে গানে যেন ছড়িয়ে দেন স্বর্গীয় আবেশ। সব শেষে লোকসঙ্গীতের সঙ্গে শ্রোতার অন্তরে ভাললাগার অনুভব ছড়ান তারুণ্যের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল চিরকুট। উৎসব উপভোগ করতে এসেছিলেন কলকাতার বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা মৃণালকান্তি রায়। নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করে বাংলাদেশের শিল্পীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শিল্পীদের গান খুব কম শোনা হয়। বিভিন্ন কারণেই তাঁদের সম্পর্কে, গান সম্পর্কে আমরা কম জানি। কিন্তু এ উৎসবে এসে বাংলাদেশের শিল্পীদের গান শুনেই খুবই মুগ্ধ হয়েছি, অভিভূতও হয়েছি।’ অদিতি মহসিন যখন রবীন্দ্রসংগীত শোনাচ্ছিলেন, তখন গোটা মিলনায়তন ভরা দর্শকশ্রোতার মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল তাঁর গান। অদিতি মহসিন একে একে গেয়ে শোনান কবিগুরুর নানা পর্বের পাঁচটি গান। শুরুতেই তিনি পরিবেশন করেন ‘তোমায় গান শোনাবো’ শিরোনামের গানটি। গানটি শেষ হতেই তুমুল করতালিতেই শ্রোতারা তাঁকে অভিনন্দন জানান। তারপর একে একে তিনি পরিবেশন করেন ‘ওগো আমার চির অচেনা পরদেশি’, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’, ‘আমার মন মানে না’ ও ‘তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’ শীর্ষক গানগুলো। তার আগে গতকাল নানা ধারার বাংলা গান গেয়ে শোনান কলকাতার কয়েকজন শিল্পী। লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন গৌতম দাস বাউল। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী জয়তী চক্রবর্তী। নজরুলসংগীত গেয়ে শোনান ইন্দ্রানী সেন। সুকোমল কণ্ঠে ইন্দ্রানী সেনের গান বাড়িয়ে দেয় দ্বিতীয় দিনের জৌলুস। তিনি একে একে গেয়ে শোনান ‘দখিন সমীরণ সাথে’, ‘নহে নহে প্রিয়’, ‘উচাটন মন ঘরে রয় না’, ‘ছাড়িয়া যেও না আর’ ও ‘ভুলি কেমনে’ শিরোনামের নানা আঙ্গিকের গান। লোকগানের নানা আঙ্গিকের গান গেয়ে কলকাতার শ্রোতাদের মাঝে ভালোলাগার পরশ বুলিয়ে দেন শিল্পী চন্দনা মজুমদার। শুরুতেই তিনি পরিবেশন করেন ‘ভক্তি দাও হে যাতে চরণ পাই’ গানটি। দর্শকশ্রোতারা গান শেষে তুমুল করতালি দিয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানায় তাঁকে। তারপর এ শিল্পাী একে একে গেয়ে শোনান ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’, ‘মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই’ শিরোনামের দুটি গান। এরপর রাধারমণের জনপ্রিয় গান ‘জলে যাইও না রে রাই’ ও বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘জাতিকুল যৌবন দিয়াছি’ গান দুটি গেয়ে তুমুল প্রশংসিত হন তিন। তাঁর শেষ পরিবেশনাটি ছিল ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গান ‘সোনার পালঙ্কের ঘরে’। উৎসবের দ্বিতীয় দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল বাংলাদেশের ব্যান্ড চিরকুটের। কথায়, সুরে, গানে আর বাদ্যের ঝংকারে কলকাতাবাসীকে নাচিয়ে ছেড়েছে চিরকুট। ইমন চৌধুরীর গিটারে হঠাৎই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বেজে উঠলে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন সবাই। এরপর  শিহরণ জাগানো বাদ্যে ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা’, ‘মরে যাব’, ‘আহারে জীবন’, ‘জাদুর শহর’, ‘কানামাছি’, ‘না বুঝি দুনিয়া’ গানগুলো দিয়ে দলটি দর্শকদের নিয়ে যায় রোমাঞ্চের তুঙ্গে। দলের নামাঙ্কিত টিশার্ট উপহার হিসেবে এনেছিল চিরকুট। মঞ্চ থেকে দর্শকদের সেসব উপহার দেন দলের প্রধান শিল্পী শারমিন সুলতানা সুমি। আর নিজেদের জন্য শুভ কামনা প্রত্যাশা করে বলেন, প্রথমবার এই মঞ্চে গাইতে এসে আপনাদের প্রতিক্রিয়ায় অনুপ্রাণিত হলাম। কম খাই বেশি খাই একসঙ্গে মিলে মিশে থাকতে চেষ্টা করি। তিন দিনের উৎসবের সমাপনী দিন আজ রবিবার। এদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় পরিবেশনা শুরু হয়ে চলবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। এদিনের পরিবেশনায় অংশ নেবে বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু। বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান শোনাবেন রূপঙ্কর। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করবেন দুর্নিবার সাহা। আধুনিক গানের সঙ্গে চলচ্চিত্রের গানে সুররসিকদের হৃদয় উদ্দীপ্ত করবেন এন্ড কিশোর, সামিনা চৌধুরী ও ইমন চক্রবর্তী। গোপাল বর্মণকে সঙ্গী করে তালবাদ্য পরিবেশন করবেন পন্ডিত বিক্রম ঘোষ। সম্মিলিতভাবে ঐতিহ্যবাহী তালবাদ্য উপস্থাপন করবেন মো. মনিরুজ্জামান, অভিষেক মল্লিক, সত্যজিৎ মুখার্জি ও দশরথ দাশ। সবশেষে রাগাশ্রয়ী সঙ্গীত পরিবেশন করবেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

3 × four =